হ্যাঁ।
আনন্দে সুকান্তর চোখের তারা দুটো চক্ করে ওঠে। বলে, দাও।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে সুকান্ত বলেছিল, বাঃ, চায়ের হাতটা তো তোমার চমৎকার!
মিত্ৰাণী চুপ করে ছিল।
কিন্তু কেমন করে জানলে? সুকান্ত চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্নটা করে।
কী?
আমি চা একটু বেশী ভালবাসি।
দিদি বলেছে।
বৌমা! সত্যি বৌমার মত আর মেয়ে হয় না। কী যে অসুখ ধরেছে ওকে! একটু যত্নআত্তি করো।
মিত্রাণী কোন জবাব দেয়নি সে কথার।
তারপর দিনের মধ্যে পাঁচ-সাতবার কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু ফুরসৎ পেলেই সুকান্তকে চা করে দিয়ে এসেছে।
সুকান্ত খুশি হয়েছে।
মধ্যে মধ্যে সুকান্তও ডেকেছে, মিতু মা!
যাই তাওইমশাই–
মিত্ৰাণী হয়তো কাজ করতে করতে জবাব দিয়েছে এবং বুঝতে পেরেছে কেন সুকান্ত ডাকছে।
তাড়াতাড়ি এক কাপ চা করে নিয়ে ঘরে ঢুকেছে।
চায়ের কাপটা হাতে নিতে নিতে সুকান্ত বলেছে, কেমন করে বুঝলে মা যে আমার চায়ের পিপাসা পেয়েছে?
মিত্ৰাণী কোন জবাব দেয়নি।
কিন্তু ইদানীং কয়েক মাস ধরে যেন সুকান্ত মিত্ৰাণীকে সহ্যই করতে পারছিল না।
এমন কি চা দিয়ে গেলেও বিরক্ত হত। মুখটা ভার-ভার এবং মিত্ৰাণীর দিকে না তাকিয়েই বলেছে, রেখে যাও।
প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি।
তখনও শকুন্তলা একটু-আধটু হাঁটা-চলা করতে পারত। মধ্যে মধ্যে শ্বশুরের ঘরে যেত শ্বশুরের খবরাখবর নিতে।
বাবা, কেমন আছেন?
আমার কথা ছেড়ে দাও, তুমি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠ।
মিত্ৰাণী জানে, বুঝতে পেরেছিল, শকুন্তলাই সুকান্তর মনটা বিষিয়ে দিয়েছিল। তার প্রতি, যার ফলে ইদানীং সুকান্ত মিত্ৰাণীর প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠেছিল।
মিত্রাণী তাই বুঝি সুকার ঘরে যাওয়াটা ক্রমশঃ কমিয়ে দিয়েছিল।
দিদিও তার প্রতি বিরক্ত, সুকান্তও বিরক্ত। ভাল লাগত না মিত্ৰাণীর ব্যাপারটা।
মধ্যে মধ্যে মনে হয়েছে, দিদিকে সে বলবে মালদহে তাকে আবার রেখে আসতে। একদিন কথাটা বলেও ছিল।
দিদি!
কি?
একটা কথা ভাবছিলাম—
ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকায় শকুন্তলা বোনের দিকে, কী কথা?
আমি মালদহেই আবার ফিরে যাই।
অকস্মাৎ যেন ক্ষেপে উঠেছিল সে কথায় শকুন্তলা।
বলেছিল, চোখের আড়াল হতে পারলে আরও সুবিধা হয়, না? জানি-তোমার ঐ ভগ্নীপতিটির পরামর্শ, তাই না?
মিত্ৰাণী চুপ করে ছিল।
শকুন্তলা বলেছিল, কিন্তু তা হবে না বলে দিও তোমার জামাইবাবুটিকে, সর্বনাশ যা ঘটতে চলেছে আমার চোখের সামনেই ঘটুক। তোমরা যে আমার আড়ালে গিয়ে তোমাদের ইচ্ছামত বেলেল্লাপনা করবে তা আমি হতে দেব না বলে তাকে। ঘাসজল খাই না, ঐ ছল-চাতুরীটুকু বোঝবার মত আমার বুদ্ধি আছে।
বলতে বলতে ক্ষোভে আক্রোশে কেঁদে ফেলেছিল শকুলা, কেন, সবই তো চলেছে, বেলেল্লাপনার তো কোন কমতিই নেই, তবে আবার চোখের আড়াল হতে চাওয়া কেন?
বলাই বাহুল্য, অতঃপর মিত্ৰাণী আর কোনদিন ওকথা তোলেনি। কিন্তু সত্যিই যেন তার ভাল লাগছিল না। চলেও হয়ত যেত। কিন্তু পারেনি ঐ রাহুল আর ভগ্নীপতি সুশার জন্যে।
সুশান্ত বার বার বলেছে, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে এখানে, আমি জানি মিত্রা–
না, কষ্ট কি।
সত্যিই কুন্তলা যেন ক্রমশঃ ইনকরিজিবিল হয়ে উঠছে—
অসুস্থ মানুষ—
কিন্তু সব কিছুরই একটা সীমা আছে, মিত্রা।
সব কথাই কদিন ধরে নতুন করে যেন বার বার মনে পড়ছে মিত্ৰাণীর।
শকুন্তলা যেন মরেনি।
তার শরীরী উপস্থিতিটাই শুধু চোখের সামনে নেই কিন্তু তবু সে যেন আছে—সর্বক্ষণ যেন তার বিদেহী একটা উপস্থিতি মিত্ৰাণী অনুভর করে এ বাড়ির সর্বত্র।
শকুন্তলার ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকালেই যেন মনে হয়–শকুন্তলা মরেনি—ঐ ঘরের মধ্যেই এখনও আছে।
দরজাটা খুললেই দেখা যাবে—এই দিকে তাকিয়েই সে বসে আছে এখনও।
দুচোখের দৃষ্টিতে ঘৃণা আক্রোশ আর সন্দেহ।
চা তৈরী করতে করতেও ঐ কথাই ভাবছিল আজ মিত্ৰাণী।
১২. ভেজানো দরজাটা ঠেলে
ভেজানো দরজাটা ঠেলে মিত্ৰাণী ঘরের মধ্যে পা দিল।
কে?
কাশতে কাশতেই চোখ তুলে তাকাল সুকান্ত।
মিত্ৰাণী কোন কথা না বলে চায়ের কাপটা নিঃশব্দে সুকান্তর শয্যার সামনে টুলটার ওপর নামিয়ে রাখল।
বিষ দিতে এসেছ-দাও দাও—এ কাজটাই বা আর বাকি থাকে কেন?
ঐ এক বুলি হয়েছে শকুন্তলার মৃত্যুর পর থেকে সুকান্তর।
খাবার দিতে ঘরে ঢুকলেই ঐ এক কথা।
বিষ-বিষ দিতে এসেছ-দাও দাও—কিন্তু এভাবে slowpoisoning করছ কেন—ধীরে ধীরে না মেরে একেবারে বেশ খানিকটা বিষ দিয়ে শেষ করে দাও না, ল্যাঠা চোকে আর তোমরাও বাঁচ।
আজও সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করে নিতান্ত যেন অনিচ্ছার সঙ্গেই চায়ের কাপটা তুলে নিল সুকান্ত।
মিত্ৰাণী ঘর থেকে বেরুবার জন্য পা বাড়ায়।
সুকান্ত পিছন থেকে ডাকে, শোন—
ফিরে দাঁড়ায় মিত্ৰাণী।
কিন্তু তোমরা যদি ভেবে থাক, ঐভাবে জ্যান্ত একটা মানুষকে বিষ দিয়ে হত্যা করে তোমরা বিয়ে করে সুখী হবে তো ভুল করছ–
মিত্ৰাণী কোন কথা বলে না।
বুড়োর মুখের দিকে চেয়ে থাকে নিঃশব্দে।
চেয়ে আছ কি? বুড়োর কথা সত্যি কি মিথ্যা জানতে পারবে একদিন। তারপর একটু বেশ দম নিয়ে বলে, হয় না-হয় না—এভাবে একজনের সর্বনাশ করে সুখ পাওয়া যায় না। কেউ কোনদিন পায়নি।
মিত্ৰাণী আর দাঁড়ায় না। ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
.
রাহুল ডাকছে।
মাসী-মাসীমণি দরজা খোল!