হ্যাঁ, আজ অফিসে যাব। সুশান্ত বলে।
মিত্ৰাণী রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এল আঁচলে হাত মুছতে মুছতে।
অফিসে যাবেন?
হ্যাঁ।
অবনীবাবু এসেছিলেন—
অবনীবাবু!
হ্যাঁ, থানার O.C., বলে গেলেন আমি ডিউটিতে জয়েন করতে পারি।
জয়েন করবেন?
হ্যাঁ-আর বসে থাকব কেন? মিছিমিছি কটা দিন বসে রইলাম। এই কটা দিনের মাইনে শুধু শুধু কাটা গেল। রাহুল বুঝি স্কুলে গিয়েছে?
হ্যাঁ।
তোমার রান্নার আর কত দেরি?
বেশী দেরি নেই। আপনি স্নান করে নিতে-নিতেই সব হয়ে যাবে।
বেশ, আমি স্নানটা করে নিই তাহলে।
সুশান্ত চলে গেল ঘরের দিকে।
শকুন্তলার ঘরটা আজও তালা দেওয়া। পুলিশই তালা দিয়ে গিয়েছে। তালা-দেওয়া ঘরটার দিকে তাকিয়ে ক্ষণেকের জন্য দাঁড়ায় সুশান্ত।
ঘরের দরজাটা সর্বদা খোলাই থাকত। এবং দরজা-বরাবর এমন ভাবে শকুন্তলার খাটটা পাতা ছিল যে খাটে শুয়ে-শুয়েই যেন সব কিছু দেখতে পেত।
ফিরে তাকাল আবার রান্নাঘরের দিকে সুশান্ত এবং তাকাতেই মিত্ৰাণীর সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়ে গেল।
মিত্ৰাণী তখনও রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরিশ্রমে ও আগুনের তাপে কপালে কিছু কিছু ঘাম জমে উঠেছে-যেন কয়েকটি টলটলে মুক্তা।
চোখাচোখি হতেই সুশান্তর দিক থেকে মিত্ৰাণী তার চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল।
সুশান্ত আর দাঁড়াল না। ঘরের মধ্যে দিয়ে ঢুকল। মিত্ৰাণী তাকাল সামনের দিকে।
শকুন্তলার ঘরের দরজায় তালাটা ঝুলছে।
.
জামা-কাপড় পরে খেতে বসে সুশান্ত হঠাৎ একসময় বলে, উঃ, এই কটা দিন যেন ভাল করে নিঃশ্বাস নিতে পারিনি।
মিত্রাণী কোন জবাব দেয় না।
সে মাংসের বাটিটা নিঃশব্দে সুশান্তর পাতের সামনে নামিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।
সুশান্ত ডাকে, মিত্রা!
মিত্ৰাণী সাড়া দেয় রান্নাঘর থেকেই, আর চারটি ভাত দেব?
না না, শোন—এদিকে এস। সুশান্ত ডাকে।
মিত্ৰাণী রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এল।
কিছু বলছেন?
হ্যাঁ, বলছিলাম আজ সন্ধ্যার শোতে সিনেমায় যাবে?
সিনেমায়! মিত্ৰাণী সুশান্তর মুখের দিকে তাকায়।
হ্যাঁ, যাবে তো বল, টিকিট কেটে নিয়ে আসব।
না।
যাবে না?
না।
কেন, চল না—ভাল বই একটা হচ্ছে!
না। পূর্ববৎ সংক্ষিপ্ত জবাব।
মিত্ৰাণী আর দাঁড়াল না।
নিঃশব্দে রান্নাঘরের মধ্যে গিয়ে আবার ঢুকল।
সুকান্ত কাশছে।
আজ কদিন থেকে সুকান্তর কাশিটা যেন বেড়েছে।
সর্বক্ষণই কাশছে ঘং ঘং করে একটা বিচিত্র ধাতব শব্দ তুলে।
মনে হয় যেন বড় কষ্ট হচ্ছে ওঁর। রান্নাঘরে বসে বসে মিত্ৰাণী ভারতে থাকে।
সুশান্তর কাছে হঠাৎ আহার্য যেন কেমন বিস্বাদ ঠেকে। উঠে পড়ে ভাতের থালা ছেড়ে। হাত-মুখ ধুয়ে জামাকাপড় পরে দীর্ঘ পনের দিন পরে সুশান্ত আবার বাড়ি থেকে বেরুল।
অফিসে ব্যাপারটা এখনও স্পষ্টাস্পষ্টি জানে না কেউ। জানে কেবল শকুন্তলা তার স্ত্রী বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। দু-চারজন বন্ধু এসে সহানুভূতিও জানিয়ে গিয়েছে।
একটা সিগারেট ধরিয়ে সুশান্ত হনহন করে এগিয়ে চলে।
আগে কোনদিন সে সিগারেট খায়নি। বাড়িতে এই কদিন বন্দী থাকতে থাকতে সিগারেট খেতে অভ্যাস করেছে সে। এককালে অবিশ্যি সিগারেট খেত, বছর দুই আগে অভ্যাসটা ত্যাগ করে ছিল। কিন্তু এখনও ঠিক ব্যাপারটা ভাল করে রপ্ত করতে পারেনি, নতুন করে আবার খেতে শুরু করে।
দু-একটা টান জোরে দিলেই কাশি আসে। মুখটা তেতো লাগে কেমন যেন।
কাশতে শুরু করে সুশান্ত এবং বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত আধখানা সিগারেট ছুঁড়ে পথের ধারে ফেলে দেয়।
বিশ্রী তেতো হয়ে গেল মুখটা। একটা মিঠে পান খেতে হবে রাস্তার ধারে পানের দোকান। থেকে। কি করে যে মানুষ ধূমপান করে!
হনহন করে হাঁটতে শুরু করে সুশান্ত।
সুশান্ত লক্ষ্য করে না, ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত একটি যুবক-এতক্ষণ যে তার কোয়ার্টারের অদূরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল, সে তাকে দূর থেকে অনুসরণ করে চলেছে।
সুশান্ত বড় রাস্তায় এসে একটা পানের দোকান থেকে একখিলি মিঠে পান নিয়ে খেলে, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে বড় রাস্তায় এসে বাস ধরল।
সেই লোকটিও ঐ একই বাসে উঠে পড়ে, ভিড়ের মধ্যে নিজেকে গোপন করে রাখে।
বাসটা যাত্রীতে একেবারে ভর্তি। অফিস-টাইম উৎরে গেলেও বাসে ভিড় যথেষ্ট তখনও। বাসটা শিয়ালদার দিকে চলেছে।
.
সুশান্ত বের হয়ে যেতে মিত্ৰাণী সদরটা বন্ধ করে দিয়ে গেল।
বেশী বেলা হয়নি। মাত্র সোয়া এগারোটা।
সুকান্ত বড্ড বেশী কাশছে আজ।
কী যে হয়েছে সুকান্তর, সে তার ঘরের সামনে গেলেই ভুকুটি করে তার দিকে তাকায়। যেন মনে হয় তাকে একেবারে দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দেবে।
সুকান্তর সেই দৃষ্টি যেন মিত্ৰাণীর সর্বাঙ্গে আগুন ধরিয়ে দেবে।
তবু মিত্ৰাণী রান্নাঘরে ঢুকে এক কাপ চা তৈরী করল বেশী দুধ চিনি ও আদার রস দিয়ে, তারপর চায়ের কাপটা হাতে সুকান্তর ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
একটু যেন ইতস্ততঃ করল, তারপর ভেজানো দরজাটা ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকল। সুকান্ত চিরদিনই একটু চায়ের ভক্ত। দিনে-রাত্রে আট-দশ বার চা পান করত। এখানে এসে প্রথম প্রথম সে চা করেও দিয়েছে বার বার সুকান্তকে। কথাটা শকুন্তলাই তাকে বলে দিয়েছিল।
বাবা একটু চা খেতে ভালবাসেন, ওঁকে মাঝে মাঝে চা করে দিস।
প্রথম দিন চা করে নিয়ে যাবার পর এক দ্বিপ্রহরে সুকান্ত কি সই না হয়েছিল। বলেছিল, কী-চা?