খুব যে দুঃসাহস দেখছি!
তা একটু আছে বৈকি।
এত বিশ্বাস!
হুঁ।
কথাটা বলে কৃষ্ণা আর দাঁড়ায় না। একটা গভীর কটাক্ষ স্বামীর প্রতি নিক্ষেপ করে ঘর ছেড়ে চলে যায়।
১১. দিন-পনের পরের কথা
দিন-পনের পরের কথা।
ইতিমধ্যে সুশান্ত আবার কাজে জয়েন করেছিল। প্রাত্যহিক ডিউটি যেমন দেয় দিতে আরম্ভ করেছিল। অবনী সাহা কয়েকদিন আগে সুশান্তর ওখানে এসে বলে গিয়েছিলেন, আপনি যেমন ডিউটি করছিলেন করতে পারেন।
শকুন্তলা-তার স্ত্রী—বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেনি।
তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, কথাটা সত্যিই যেন কেমন একটু বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল তাকে।
সেই সঙ্গে যে মনের মধ্যে একটা আশঙ্কাও দানা বেঁধে ওঠেনি তাও নয়।
সর্বক্ষণ কেমন যেন একটা ভয়-ভয়।
এমন সময় অবনী সাহা এসে ঐ কথা বললেন।
মনে হল অবনী সাহার কথায় যেন সুশান্তর মনের উপর থেকে একটা পাষাণভার নেমে যায়।
এবং বোধ হয় আরও বেশী করে নিশ্চিত হবার জন্যই প্রশ্ন করে, মিঃ সাহা।
কিছু বলছিলেন?
হ্যাঁ, মানে–এখনো কি আপনাদের ধারণা—
কী?
মানে বলছিলাম, আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করেনি, তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে কেউ হত্যা করেছে!
আরে মশাই, যত সব উদ্ভট idea মিঃ রায়ের-plain simplecase of suicide, অথচ তিনি বলতে চান তাকে হত্যা করা হয়েছে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে।
কিন্তু তিনি যে কি বলেছিলেন–
কী?
আপনাদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নাকি—
হ্যাঁ, ছেড়ে দিন তো। ডাক্তারগুলোও হয়েছে তেমনি!
সত্যি মশাই, সুশান্ত বলে, সেদিন তো কিরীটীবাবুর মুখে ঐ কথা শুনে আমি অবাক। বলেন কি! তাছাড়া মিত্ৰাণী তাহলে ব্যাপারটা কি জানতে পারত না? সে তত জেগেই ছিল বলতে গেলে সে-রাত্রে!
অবনী সাহা অতঃপর জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার ছেলে রাহুল কেমন আছে?
ভাল-ভাল হয়ে গেছে।
আর সেরকম ভয়টয় পায় না তো?
না।
আচ্ছা তাহলে আমি উঠি সুশাবাবু।
বসুন বসুন-চা খেয়ে যান।
না, এখন আর চা খাব না।
না না, বসুন নাচা না খান, কফি কিংবা ওভালটিন—
না, কিছু প্রয়োজন নেই। মৃদু হেসে অবনী সাহা বলেন, আমি তাহলে উঠি।
অবনী উঠে পড়েন।
সুশান্ত একটা সিগারেট ধরায়। এবং ধূমপান করতে করতে একসময় সুশান্ত এসে জানালাটার সামনে দাঁড়ায়।
বাইরে আলোঝলমল প্রকৃতি।
গেটের সামনে এই কোয়ার্টারে এসে শকুন্তলা শখ করে একটা রক্তকরবীর গাছ এনে পুতেছিল।
হঠাৎ নজরে পড়ল সুশান্তর, গাছটা একেবারে ফুলে ফুলে যেন ছেয়ে গিয়েছে। থোকা থোকা লাল ফুল। কেবল রক্তকরবীই নয়। শকুন্তলার বরাবর ফুলের শখ।
সে আবার নানা প্রকারের ফুলগাছ এনে কোয়ার্টারের সামনে যে ছোট জমিটুকু-সেই জমিতে পুঁতেছিল।
গরীবের ঘর থেকে নিজে পছন্দ করে শকুন্তলাকে বিয়ে করে এনেছিল সুশান্ত।
তখনও তার চাকরি বেশী দিন হয়নি। সামান্য দুবছর মাত্র হয়েছে। নিজের আলাদা ফ্যামিলি-কোয়ার্টারও পায়নি। কোয়ার্টার তো মাত্র বছর-তিনেক হল পেয়েছে সুশান্ত।
কোয়ার্টার পাওয়ার আগে শকুন্তলা তো তার মায়ের কাছেই ছিল কৃষ্ণনগরে। যাতায়াত করত সুশান্ত সেখানে।
শাশুড়ীরও ঐ একমাত্র মেয়ে।
কী আনন্দ কোয়ার্টারে এসে শকুন্তলার! সুখের ছোট্ট সংসারটি। স্বামী-স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে রাহুল।
আনন্দের-শান্তির সংসার।
কিন্তু দেড়টা বছরও গেল না, অনেকদিন পরে দ্বিতীয়বার সন্তান হতে গিয়ে একটি মৃত সন্তান প্রসব করে শকুন্তলা অসুস্থ হয়ে পড়ল।
শকুন্তলার শরীরটা যেন ভেঙে গেল। রেলের ডাক্তারকে দেখানো হল। তিনি বললেন স্প্রু। ক্রমশঃ শকুন্তলা রোগে রোগে জীর্ণ হয়ে যেন শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল।
সেই সময়-হ্যাঁ, সুশান্তর মনে পড়েছে, রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে শকুন্তলাও যেমন ক্রমশঃ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সুশান্তও যেন ক্রমশঃ তেমনি বিরক্ত হয়ে পড়েছিল।
রোগ রোগ, আর লোগ। কেবল রোগের আর ঔষধের ফিরিস্তি।
সেই সময়ই একটু একটু করে সুশান্ত যেন সংসার থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে। কাজকর্মের ফাকে ফাকে যেটুকু সময় পেত, বাড়িতে আসতে মন যেন কিছুতেই চাইত না। হয় বন্ধু বান্ধবের বাসায়, না হয় ক্লাবে আডড়া দিয়ে বাইরে বাইরেই কাটিয়ে আসত। ঐসময় বাপ সুকান্তও যেন ক্রমশঃ অথর্ব হয়ে পড়তে থাকেন।
বরাবরই হাঁপানী রোগ ছিল।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই হাঁপানী রোগটা যেন আরও বেশী করে সুকান্তকে আক্রমণ করে। তিনি একপ্রকার শয্যাশায়ীই হয়ে পড়েন।
দুধারে দুজন রোগী—এক ঘরে স্ত্রী, অন্য ঘরে বাপ সুকান্ত। সংসারটা ক্রমশঃ অচল হয়ে উঠতে থাকে। সুশান্তর মন-মেজাজ ক্রমশঃ বিশ্রী হয়ে উঠতে থাকে যেন। ভাল লাগে না—কিছু তার ভাল লাগে না। হাতের সিগারেটটা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, সেটা ছুঁড়ে জানালার বাইরে ফেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সুশান্ত।
ঘুরে দাঁড়াতেই দেওয়ালে টাঙানো শকুন্তলার ফটোটার ওপরে নজর পড়ল। বিয়ের পরে ভোলা শকুন্তলার ফটো। যৌবনলাবণ্যে যেন ঢলঢল করছে।
শকুন্তলা হাসছে।
মিত্ৰাণী বোধ হয় রাঁধছে, বাতাসে চমৎকার মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে।
মিত্ৰাণী!
ও-ঘর থেকে সুকান্তর কাশির শব্দ আসছে। সুশান্ত ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। রান্নাঘরের দরজাটা খোলা। মিত্ৰাণী রান্নাঘরে রাঁধছে।
মিতা!
মিত্ৰাণী সুশান্তর ডাকে সাড়া দেয়, ডাকছেন জামাইবাবু?