- বইয়ের নামঃ মোমের আলো
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. যেমন ঝড় তেমনি বৃষ্টি
সারাটা রাত ধরে যেমন ঝড় তেমনি বৃষ্টি।
অবিশ্রান্ত বর্ষণের সঙ্গে সোঁ সোঁ হাওয়া।
আর সেই সঙ্গে ছিল থেকে থেকে মেঘের গুরু গুরু ডাক।
ঐ ঝড় জল বৃষ্টির মধ্যেই কোন এক সময় সম্ভবত ঘটনাটা ঘটেছে বলে অবনী সাহার ধারণা।
নাইট ডিউটি ছিল সুশান্ত চ্যাটার্জির।
ট্রেনের গার্ড সুশান্ত চ্যাটার্জি।
আগের দিন সকালে বের হয়ে গিয়েছিল ডিউটি দিতে, ফিরেছে পরের দিন খুব ভোরে।
ট্রেনটা ইন করেছিল অবিশ্যি রাত আড়াইটে নাগাদ এবং ডিউটিও সুশান্তর তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তখনো সে ফেরেনি, রেস্টিং রুমে নাকি সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল।
পরে ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সুশান্ত কোয়ার্টারে ফিরে এসেছে এবং ঘরে ঢুকেই থমকে নাকি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সে, শয্যায় শায়িতা স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে।
ওর স্ত্রী শকুন্তলা অবিশ্যি বেশ দীর্ঘকাল ধরেই নানা রোগে ভুগছিল এবং ইদানীং প্রায় শয্যাশায়ীই থাকত।
সংসারের কাজকর্ম কিছুই সে করতে পারত না।
মেজাজটাও যেন কেমন খিটখিটে হয়ে উঠেছিল এবং নিজে বেশির ভাগ সময়ই অসুস্থ থাকত বলে ঘরের কাজকর্ম দেখার জন্য মাস-ছয়েক আগে মিত্ৰাণীকে নিয়ে এসেছিল নিজেই স্বামীকে অনুরোধ করে মালদহ থেকে।
সুশান্ত নাকি প্রথমটায় রাজী হয়নি।
অবশেষে স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে রাজী হয়েছিল।
শকুন্তলার দূরসম্পকীয়া বোন মিত্ৰাণী।
মালদহে ছিল, সেখান থেকেই তাকে আনানো হয়েছিল।
বাড়িতে প্রাণীর মধ্যে চারজন।
সুশান্ত—তার বৃদ্ধ হাঁপানির রোগী বাপ সুকান্ত, আট বছরের একটি ছেলে রাহুল, রুগ্না স্ত্রী শকুন্তলা আর ইদানীং মাস-ছয়েক হয় এসেছিল ওদের সংসারে মিত্ৰাণী-শকুন্তলার দুরসম্পর্কীয়া বোন।
.
সুশান্তর চিৎকারেই মিত্ৰাণী রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসে।
কি-কি হয়েছে জামাইবাবু? মিত্ৰাণী জিজ্ঞাসা করে।
মিত্রা, তোমার দিদি-সুশান্ত তার কথা শেষ করতে পারে না।
কি হয়েছে দিদির?
মিত্ৰাণী তখনও ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি।
মনে হচ্ছে বেঁচে নেই—দেখ—
সে কি! না না-মিত্ৰাণী তার দিদি শকুন্তলার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে।
হ্যাঁ, ছুঁয়ে দেখ, একেবারে ঠাণ্ডা-বরফ। মনে হচ্ছে সী ইজ ডেড–মারা গেছে—
সুশার কথায় মিত্ৰাণী যেন একেবারে বোবা পাথর হয়ে গিয়েছিল।
কী একটা অজ্ঞাত আতঙ্কে তার সমস্ত দেহ যেন তখন একেবারে হিম হয়ে গিয়েছে।
মিত্ৰাণী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে যেন বোকার মতই কিছুক্ষণ সামনের দিকে।
শকুন্তলা এমনিতেই রীতিমত ফরসা, তার উপর দীর্ঘদিন ধরে ভুগে ভুগে কেমন যেন মোমের মত ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল।
রক্তহীন ফ্যাকাশে।
গালটা ভেঙে তুবড়ে গিয়েছিল। সেই তোবড়ানো গালে কোটরগত চোখের তারা দুটো যেন কি এক অজ্ঞাত জিজ্ঞাসায় ঠেলে বের হয়ে এসেছে।
শুধু জিজ্ঞাসা নয়, তার সঙ্গে যেন একটা বিভীষিকাও জড়িয়ে আছে।
রুক্ষ মাথার পর্যাপ্ত চুল বালিশের উপর পড়ে আছে।
ডান হাতটা দেখা যাচ্ছে না।
বাঁ হাতটা অসহায়ভাবে বালিশের উপর পড়ে আছে।
আর সেই হাতের পাশেই পড়ে আছে একটা ছোট শিশি।
লাল লেবেল আটা শিশির গায়ে লেখা ইংরেজীতে-পয়জন।
শকুন্তলা যে তখন আর বেঁচে নেই, সে যে মরে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে-সেটা বুঝতে মিত্ৰাণীরও কষ্ট হয়নি।
শকুন্তলার মুখের দিকে তাকাবার পরই সেটা বুঝতে পেরেছিল।
এবং বিষের শিশিটা তার পাশেই-শয্যার উপর তখনও পড়ে আছে। এটা বুঝতে কষ্ট হয় না, শকুন্তলা ঐ মালিশের ঔষধটা খেয়েই মারা গিয়েছে।
সত্যি সত্যিই মারা গিয়েছে, না আত্মহত্যা করেছে তার দিদি শকুন্তলা!
আত্মহত্যা? শকুন্তলা—তার দিদি আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু কেন আত্মহত্যা করেছে? হঠাৎ যেন একট কথা মনে হয় মিত্ৰাণীর।
কাল রাত্রে—
কাল রাত্রে শোবার আগে—
আকাশে প্রচণ্ড মেঘ করেছিল।
মেঘে মেঘে একেবারে আকাশটা কালো কালির মত হয়ে উঠেছিল যেন, মিত্ৰাণীর মনে পড়ছে।
বৃষ্টি হয়ত এখুনি নামবে।
তাই শোবার আগে মিত্ৰাণী কাজকর্ম সেরে তার দিদির ঘরে এসেছিল জানলাগুলো বন্ধ করে দিতে।
শকুন্তলা তখনো জেগেই ছিল।
যদিও রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা।
রাহুল অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশের ঘরে সুশান্তর বাবার থেকে থেকে কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
শকুন্তলা যে তখনও ঘুমোয়নি মিত্ৰাণী সেটা জানত।
ইদানীং মাস-দুই প্রায়-বলতে গেলে শকুন্তলা সারাটা রাত ধরে জেগেই থাকত।
ঘুম একটা তার বড় হত না।
প্রথম প্রথম ঘুমের ঔষধ দিত, ইদানীং কিছুদিন কী যে হয়েছিল শকুন্তলার, ঘুমের ঔষধ কিছুতেই খেতে চাইত না।
সারারাত জেগে থাকবে তবু ঔষধ খাবে না কিছুতেই।
জিদ ধরে থাকত। ঘুমের ঔষধের কথা বললেই বলত, না, খাবো না, ঘুমের ঔষধ আমি খাবো না–
সুরেন ডাক্তার দীর্ঘদিনের পরিচিত ওদের।
সে হয়ত বলেছে, কেন—কেন খাবেন না?
না, খাবো না-চেঁচিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছে শকুন্তলা।
খেলে ঘুম হবে, ঘুমোতে পারলে দেখবেন অনেকটা সুস্থবোধ করছেন আপনি মিসেস চ্যাটার্জি। আপনার ঘুমের দরকার।
ডাক্তার বার বার চেষ্টা করেছেন।