জায়গাটা কিন্তু অসম্ভব জ্বালা করছে! মৃদুস্বরে পুনরায় কথাটা বলতে বলতে সুহাস আবার জায়গাটায় হাত বোলাতে থাকে।
এরপর সকলে নির্দিষ্ট কামরায় এসে উঠে বসে।
কথায় কথায় তখনকার মত আপাততঃ সমস্ত ব্যাপারটা একসময় চাপা পড়ে যায়।
সুধীন ট্রেনের কামরার বাইরে জানালার উপরে হাত রেখে সুহাসের সঙ্গে তখন মৃদুস্বরে কথাবার্তা বলছিল।
গাড়ি ছাড়বার আর মাত্র মিনিট দশেক বাকি আছে।
প্রথম ঘণ্টা পড়ল।
হাতটা এখনও জ্বালা করছে সুধীদা! মৃদস্বরে সুহাস বলে।
কই দেখি? সুধীনের প্রশ্নে সুহাস পাঞ্জাবির হাতাটা তুলে জায়গাটা দেখাল এতক্ষণে।
ট্রাইসেপ্স মাস্লের উপর একটা ছোট্ট রক্তবিন্দু। খানিকটা জায়গা লাল হয়ে সামান্য একটু ফুলে উঠেছে, তখন সুধীন দেখতে পায়।
সুধীন বললে, একটু আয়োডিন দিতে পারলে ভাল হত। যাক্ গে— কিছুই হয়ত করতে হবে না। কালই হয়তো সেরে যাবে।
কি করে যে কি হল ঠিক যেন বুঝতে পারলাম না। তাড়াতাড়িতে মনে হল যেন কি একটা ছুঁচের মত বিধেই আবার বের হয়ে গেল—সুহাস মৃদু ক্লিষ্ট স্বরে বললে।
সুহাসের ঠিক পাশেই মালতী দেবী বসে, মুখখানা তাঁর বেশ গম্ভীর। মৃদু স্বরে তিনি বললেন, অমাবস্যা, তখনই বলেছিলাম। আজ না বের হলেই হত। কিন্তু তোদর সব আজকালকার সাহেবীয়ানা।…এখন ভালয় ভালয় পৌঁছতে পারলে বাঁচি।
ট্রেন ছাড়বার শেষ ঘণ্টা পড়ে।
যতক্ষণ গাড়ির জানলাপথে দেখা যায়, সুহাস তাকিয়ে থাকে, সুধীনও প্লাটফরমের ওপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রুমালটা ওড়াতে থাকে।
ক্রমে একসময় চলমান গাড়ির পশ্চাতের লাল আলোটা অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যায়।
সুধীন গেটের দিকে অগ্রসর হয়।
১.০৪ প্লেগ ব্যাসিলাই
ব্যথা কমা তো দূরে থাক, হাতটার ব্যথা যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে, কেমন ঝিঁঝিন্ করে সমস্ত হাতটা যেন অসাড় মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যে।
সুহাস বার্থের বিস্তৃত শয্যার ওপরে গা-টা এলিয়ে দিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করে। কিন্তু বৃথা–!
সমস্ত রাতের মধ্যে সুহাস একটি বারের জন্যও চোখের পাতা বোজাতে পারলে না। ব্যথায় ও অস্বোয়াস্তিতে এপাশ-ওপাশ করতে থাকে।
সমস্ত হাতটা টন্ করছে। জ্বর-জ্বরও বোধ হচ্ছে। এমনি করেই রাতটা কেটে গেল।
পরের দিন সকালবেলা স্টেশনে নেমে রাজবাড়ির মোটরে করে সকলে এসে প্রাসাদে পোঁছল।
এবং সেদিনই রাত্রের দিকে সুহাসের অল্প অল্প জ্বর দেখা দেয় প্রথম।
পরের দিন সকালে রাজবাড়ির ডাক্তার অমিয় সোমকে ডেকে আনা হল, তিনি দেখেশুনে বললেন, ও কিছু না, ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই। সামান্য ঠাণ্ডা লেগে ইনফ্লুয়েঞ্জা মত হয়েছে, গোটা দুই অ্যাপ্রিন্ খেলেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে। হাতটার যেখানে সামান্য ফুলে লাল হয়ে ব্যথা হয়েছে, সেখানে একটু গরম সেঁক দিলেই হবে।
কিন্তু দিন দুই পরেও দেখা গেল জ্বরটা একেবারে বিচ্ছেদ হয়নি, ৯৯° থেকে ১০১°–এর মধ্যেই থাকছে। গলায় ও কোমরে সামান্য সামান্য বেদনা—হাতের ফোলাটা অবিশ্যি অনেকটা কম।
আবার ডাক্তার এলেন, সম্ভব-অসম্ভব তাঁর বিদ্যামাফিক পরীক্ষা করে তিনি নবীন উদ্যমে নতুন ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করলেন। এবং এবারও বললেন, ভয় বা চিন্তার তেমন কোন কারণ নেই। এমনি করেই আট-দশটা দিন কেটে গেল এবং সেই আট-দশদিনেও জ্বর রেমিশন হল না। গলার দু-পাশে, বগলের নীচে, কুঁচকিতে গ্ল্যাণ্ডসগুলো ব্যথা হয়ে সামান্য বড় হয়েছে বলে মনে হল।
মালতী দেবী কিন্তু এবারে বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলেন। হাজার হলেও মার প্রাণ তো!
সুবিনয়কে একদিন সকালে ডেকে বললেন, বিনয়, আট-দশদিন তো হয়ে গেল, কিন্তু সুহাসের জ্বর তো কমছে না কিছুতেই; কলকাতা থেকে কোনো একজন ভাল ডাক্তার এনে দেখালে একবার হত না?
সবতাতেই তোমার ব্যস্ত ছোট মা! পথে আসতে ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হয়েছে, দু-চারদিন পরেই সেরে যাবে। তাছাড়া ডাক্তার দেখছে, ওষুধ খাচ্ছে। এতই যদি তোমার ভয় হয়ে থাকে—তবে ডাঃ কালীপদ মুখার্জীকে না হয় আসবার জন্য একটা তার করে দিচ্ছি।
তাই না হয় করে দাও। অমিয়র চিকিৎসায় তো এক সপ্তাহ প্রায় রইল, কোনো উপকারই তো দেখা যাচ্ছে না, সময় থাকতে সাবধান হওয়াই কি ভাল নয়? শেষে রোগ বেঁকে দাঁড়ালে মুশকিল হবে।
ডাঃ কালীপদ মুখার্জী কলকাতা শহরের একজন মস্তবড় নামকরা ডাক্তার।
মাসে তিনি অনেক টাকাই উপায় করেন।
রায়পুরের রাজবাড়িতে তাঁর অনেক দিন হতেই চিকিৎসাসূত্রে যাতায়াত। এককথায় তিনি স্টেটের কনসালটিং ফিজিসিয়ান।
রায়পুরের রাজবাড়িতে কখনও কোনো কঠিন কেস হলে কলকাতা থেকে কাউকে আনতে হলে সর্বাগ্রে তাঁরই ডাক পড়ে, এবং বহুবার তিনি রাজবাড়ির অনেকের অনেক দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করে আরাম ও সুস্থ করে তুলেছেন। এ বাড়ির সঙ্গে তিনি বিশেষভাবেই পরিচিত।
তাঁর অমতে বা তাঁর অজ্ঞাতে রাজবাড়িতে কখনও অন্য কোনো বড় ডাক্তারকে আজ পর্যন্ত ডাকা হয়নি।
বহুবার যাতায়াতের জন্য রাজবাড়ির সঙ্গে ডাঃ মুখার্জীর অত্যন্ত হৃদ্যতা জমে উঠেছে।
রাজবাড়ির একজন হিতৈষী বন্ধুও বটে তিনি।
আর দেরি না করে ঐদিনই সকালের দিকে তাঁকে আসবার জন্য একটা জরুরী তার করবার জন্য মালতী দেবী বারংবার বলতে লাগলেন।
যদিচ অমিয় ডাক্তার বার বার বলতে লাগলেন, ভয় নেই রাণীমা, সামান্য জ্বর, ও দু-চারদিন নিয়মিত ওষুধপত্র খেলেই ভাল হয়ে যাবে।