ক্রমে আরও দেখা-সাক্ষাৎ আলাপ-আলোচনার ভিতর দিয়ে দুজনের মধ্যে যখন একটা বেশ মিষ্ট ঘনিষ্ঠতা জমে উঠেছে, সেই সর্বপ্রথম সুধীন হঠাৎ একদিন কথাবার্তার মধ্য দিয়ে জানতে পারল সুহাসের আসল ও সত্যকারের পরিচয়টা কি। এবং সুহাস যে তাদের চিরশত্রু রায়পুরের রাজবাড়িরই ছোট কুমার এ-কথাটা ভাবতে গিয়ে অকস্মাৎ সেদিন কেন যেন বুকের ভিতর তার হঠাৎ কেঁপে উঠল।
এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গিয়েছিল সেদিন সুধীনের মার মুখে এক ঝড়-জলের রাত্রে শোনা সেই অভিশপ্ত কাহিনী।
মৃদু মোমবাতির আলোয় মার সেই অদ্ভুত শান্ত কঠিন মুখখানা আজও যেন ঠিক বুকের মাঝখানটিতে একেবারে দাগ কেটে বসে আছে। স্পষ্ট করে কোনো কথা না বললেও মা যে ঠিক সেরাত্রে অতীতের সেই একান্ত পীড়াদায়ক কাহিনী শুনিয়ে ছেলেকে কি বলতে চেয়েছিলেন, সুধীন তার জবাবে কোনো কিছু না বললেও মার কথার মর্মার্থটুকু বুঝতে তার কষ্ট হয়নি।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ঘটনা যতই মর্মপীড়াদায়ক ও মর্মন্তুদ হোক না কেন, ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সংবই ছিল না, এবং ঘটনাকে উপলব্ধি করবার মত তার সেদিন বয়সও ছিল না। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মনের মধ্যে কোনো প্রতিহিংসার স্পৃহাই যেন সুধীনের কোনো দিন জাগেনি। যে পিতাকে সে জানবার বা বোঝবার কোনো অবকাশই জীবনে পায়নি, যার স্মৃতিমাত্রও তার মনের মধ্যে কোনো দিন দানা বেঁধে উঠতে পারেনি, তার হত্যা-ব্যাপারে নিছক একবারে কর্তব্যের খাতিরে নিজেকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলতে কোথাও যেন তার রুচি ও বিচারে বরাবরই বেধেছে। তাই সুহাসের সঙ্গে ভাল করে ঘনিষ্ঠতার পর যেদিন প্রথম সে সুহাসের সত্যিকারের আসল পরিচয়টুকু জানতে পারলে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েই পড়েছিল।
এবং একান্তভাবে মার কথা ভেবেই সে তারপর আপ্রাণ চেষ্টা করে সুহাসকে এড়িয়ে চলবার জন্যে।
কিন্তু মুশকিল বাধল তার সরলপ্রাণ মিশুঁকে সুহাসকে নিয়েই, কারণ সুহাস ঐ ব্যপারের বিন্দুবিসর্গও জানত না। তাই সুধীন তাকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও সুহাস তাকে এড়িয়ে যেতে দিত না, সে পূর্বের মতই যখন তখন সুধীনের বাসায় এসে হাসি গল্পে আলোচনায় সুধীনকে ব্যস্ত করে তুলতে লাগল দিনের পর দিন এবং বন্ধুত্ব ও আলাপের জেরটা টেনে সুদৃঢ় করে তুলল যেন আরও।
সুধীনের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
ঘনিষ্ঠতা দুজনের মধ্যে ক্রমেই বেড়ে ওঠে, এমন কি দু-তিনবার সুধীন মার অজ্ঞাতেই রায়পুর গেল।
প্রথমটায় সে অনেকবার চেষ্টা করেছে মার কাছে সব খুলে বলবার জন্য কিন্তু যখনই সেই বিস্মৃত কাহিনী ও সেরাত্রের মার মুখের সেই কঠিন ভাব মনে পড়েছে, ও সংকুচিত হয়ে পিছিয়ে এসেছে।
মার কাছে আর কোনো দিন বলাই হল না।
***
সেদিন আসন্নবর্তী রায়পুর যাত্রার জন্য আবশ্যকীয় জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে সুধীন ও সুহাসের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল।
সুহাস বলছিল,আজ আর তোমাকে আমি ছাড়ছি না সুধীদা। আজ সন্ধ্যার পরে একেবারে আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তবে কিন্তু তোমার ছুটি।
কিন্তু আমার হাতে যে ভাই দুটো কে আছে, দুপুরে একবার রোগী দুটি দেখে আসতেই হবে।
বেশ, ড্রাইভারকে বলে দেব, আমার গাড়ি নিয়ে রোগী দেখেই আবার চলে আসবে এখানে, দুজনে একসঙ্গে আজ দুপুরে খাব। আবদার করে সুহাস বলে।
সুধীন হাসতে হাসতে জবাব দেয়,বেশ, তাই হবে।
সন্ধ্যার ঠিক একটু পরেই সকলে স্টেশনে এসে পৌঁছল। গাড়ি ছাড়বে রাত আটটায়।
সঙ্গে সুহাসের মা মালতী দেবী, সুহাসের দাদা সুবিনয়, সুবিনয়ের একমাত্র ছেলে প্রশান্ত, স্টেটের ম্যানেজার সতীনাথবাবু, এঁরাও সকলেই চলেছেন রায়পুর।
স্টেশনে অসম্ভব ভিড়। সুহাসের পাশে পাশেই চলেছে সুধীন।
ফার্স্ট ক্লাস কুপে একটা রিজাত করা হয়েছে।
সুহাসের মা মালতী দেবী একবার বলেছিলেন, আজ অমাবস্যা, আজ রওনা না হলেই হত।
হ্যাঁ! তোমাদের মেয়েদের যেমন! আজ অমাবস্যা, কাল দিকশূল, পরশু অশ্লেষা! যত সব! এত করলে বাড়ির বার হওয়াই দায়রাগত স্বরে সুবিনয়বাবু প্রতিবাদ করেন।
কি জানি, মনটা যেন খুঁতখুঁত করছে। সেবারে এরকম অদিনে গিয়েই সুহাসের টিটেনাস হল। মালতী দেবী মৃদু স্বরে বলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্রের কোনো কাজে প্রতিবাদ জানাতেও তাঁর ভয় করে।
স্টেশনের গেট দিয়ে ঢোকবার সময় আগে সুহাস, তার ডানদিকে সুধীন, পিছনে সুবিনয়বাবু,—বিশ্রী রকম ভিড়, ঠেলাঠেলি চলেছে, সুহাস কোনোমতে গেট দিয়ে প্ল্যাটফরমে ঢুকতে যাবে, পাশ থেকে একটি কালো মোটা গোছের লোক, বগলে একটা নতুন ছাতা, একপ্রকার সুহাসকে ধাক্কা দিয়েই যেন প্ল্যাটফরমে ঢুকে গেল! এবং কতকটা সঙ্গে সঙ্গে সেই ছাতাওয়ালা লোকটার ধাক্কা খেয়ে উঃ করে অর্ধস্ফুট যন্ত্রণাকাতর একটা শব্দ করে ওঠে সুহাস।
কি হল? সুধীন ব্যথভাবে প্রশ্ন করে সুহাসকে।
সুহাস ততক্ষণে কোনোমতে ধাক্কা খেয়ে প্ল্যাটফরমের মধ্যে এসে ঢুকেছে, তার সঙ্গে সঙ্গে সুধীন ও সুবিনয়। সুবিনয়ও এগিয়ে আসে, কি হল!
ডান হাতের উপরে কি যেন ছুঁচের মত একটা ফুটল। উঃ—এখনও জ্বালা করছে! লংক্লথের পাঞ্জাবির উপরেই সুহাস ব্যথার জায়গাটিতে কতকটা অজ্ঞাতসারেই যেন নিজে নিজে হাত বোলায়।
দেখি!… সুবিনয় সুহাসের পাঞ্জাবির হাতাটা তুলে ব্যথার জায়গাটা বেশ করে টিপে টিপে মালিশ করে দিতে দিতে বলে, কিছু না। বোধ হয় কিছুতে খোঁচা লেগেছে। ও এখুনি ঠিক হয়ে যাবেখন, একটু সাবধান হয়ে চলতে ফিরতে হয়—তোমরা যেমন ব্যস্তবাগীশ!