কিন্তু তারও আগে আলোচনা করব, সত্যিই যদি সুধীনই সুহাসের হত্যাকারী হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে সুধীনের সুহাসকে হত্যার কি মোটিভ বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে? বলবেন, প্রতিশোধ! তার পিতার নৃশংস হত্যার প্রতিশোধ! কিন্তু আমি বলব—absurd! Simply absurd! সুধীনের পিতা যখন নিহত হন, কতটুকু শিশু ছিল সুধীন! তারপর একদিন বয়স হলে মার মুখে সব কিছু সে শুনলে, তখন তার মার পক্ষে যে প্রতিহিংসা বা বিদ্বেষ থাকা সম্ভব, সেটা সুধীনের পক্ষে গড়ে ওঠা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। তাছাড়া ঘটনাচক্রে যাদের প্রতি গড়ে ওঠা উচিত ছিল একটি পরিপূর্ণ ঘৃণা ও বিদ্বেষ, সেখানে গড়ে উঠল একটা মধুর প্রীতির বন্ধন এবং সেটা একান্ত অজান্তেই। সুহাসের সঙ্গে ভালবাসাটা গাঢ় হয়ে ওঠবার পর যেদিন প্রথম সুধীন জানতে পারলে সুহাসের আসল পরিচয়, তখন তার মনে আর যাই হোক হিংসা বা ক্রোধ জাগতে পারে না। এই গেল প্রথম কথা।
দ্বিতীয় কথা, যদি ধরেই নিই অর্থের লোভে সুধীন সুহাসকে হত্যা করেছে, তাও অসম্ভব, কারণ সে ঘুণাক্ষরেও দ্বিতীয় উইল সম্পর্কে কিছু জানত না। এবং শুধু তাই নয়, অর্থের প্রতি যদি তার লোভই থাকবে, তাহলে সুহাস যখন তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিল তখন মালতী দেবীকে সে তার ব্যবসার অংশীদার করত না।
তৃতীয়ত সুহাসকে সুধীনের যদি খুন করবারই মতলব থাকত, তাহলে প্রথমবার যখন সে টিটেনাস রোগে আক্রান্ত হয়, তখন তাকে নিজে কলকাতায় নিয়ে এসে চিকিৎসার সুব্যবস্থা নিশ্চয়ই করত না। এই তিনটি করণেই আমার মনে হয় সুধীনকে আমরা অনায়াসেই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারি। এবং তাই যদি হয় তাহলে সুধীনকে যে হত্যাকারী ইচ্ছা করেই কোন গভীর উদ্দেশ্যে সুহাসের হত্যাব্যাপারের সঙ্গে জড়িয়েছিল সেটা প্রমাণ হয়ে যায় না কি? তাই বলছিলাম হত্যাকারী দুটি কারণে সুধীনকে হত্যা-মামলার সঙ্গে জড়িয়েছিল। যেহেতু (১) হত্যাকারী উইলের ব্যাপার জানত এবং (২) জানত নিশ্চয়ই উইলের দ্বারা সুধীন লাভবান হবে—তাই মনে হয়, ঐ অ্যানটিটিটেনাস ইনজেকশন দেওয়ার সুযোগে হত্যাকারী সুধীনের বিরুদ্ধে মস্ত বড় একটা প্রমাণ হাতে পেয়েছিল, যার দ্বারা অনায়াসে হত্যার সমস্ত অপরাধ তার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজে সমস্ত সন্দেহের বাইরে চলে যেতে পেরেছিল আইনের চোখে ধুলো দিয়ে। আগেই বলেছি সুধীন নিজের বোকামিতেই অনেকটা নিজেকে বিপদগ্রস্ত করে ফেলে। সুহাসের মৃত্যুর ঠিক কয়েকদিন আগে সুধীন বেনারসে চলে গেল, আবার মাঝখানে এসে মৃত্যুর সময়টা বেনারসে চলে গেছিল। এতে করে স্বভাবতই লোকের মনে সুধীনের প্রতি সন্দেহ জাগতে পারে। তাছাড়া স্টেশনেও সে উপস্থিত ছিল। হিমোসাইটোমিটার যন্ত্রটার কোন একটা ভাল রকম explanation-ও সে দিতে পারল না। যদিও এক্ষেত্রে ডাঃ মিত্রের জবানবন্দির সত্যতাও আমি মেনে নিতে রাজী নই। আমার মতেমিঃ হালদারের ঐসম্পর্কে explanation-টাই সত্যি। ডাঃ মিত্র সত্য গোপন করেছিলেন। সুহাসের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স সম্পর্কেও সকল সন্দেহের নিরসন হয়ে যায় মালতী দেবীর statement থেকেই। এবং এ কথাও সেই সঙ্গে প্রমাণ হয় মালতী দেবীকে বাঁচাতে গিয়েই এবং সুহাসের মৃত আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাবশেই ডাঃ সুধীন চৌধুরী আনক ব্যাপার ইচ্ছে করেই চেপে গেছে আদালতে বিচারের সময় জেরার মুখে। তারপর সুহাসের কলকাতায় আগমন সংবাদ—সে-ও কেমন করে সুধীন চৌধুরী পায় তারও প্রমাণ পেয়েছেন মালতী দেবীর চিঠির জবানবন্দিতেই। তিনিই আগের বারের মত ডাঃ সুধীনকে সুহাসের অসুস্থতার সংবাদ দিয়েছিলেন। সুহাসের অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় পৌঁছবার পর তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েই ডাঃ সুধীন তার এক বন্ধুর বিয়েতে, বন্ধুর একান্ত অনুরোধ না এড়াতে পেরেই, কয়েকদিনের জন্য বেনারস চলে যেতে বাধ্য হয় তার অনিচ্ছাতেই। এখন কথা হচ্ছে, আদালতে জেরার সময় সুধীন চৌধুরী কেমন করে সুহাসের কলকাতায় আসবার সংবাদ পান, সেটা জানাতে কেন অস্বীকার করে! তার কারণ মালতী দেবী অনুরোধ করেছিলেন, সুহাস যেন কাউকে কথাটা না বলে। ব্যাপারটা আগাগোড়া এখানে অসম্ভব ও অস্বাভাবিক বোধ হলেও, সুধীন মালতী দেবীকে exposeকরেনি। ডাঃ সুধীনের আদালতের সমগ্র ব্যাপারটা study করে আমার ধারণা হয়েছে, লোকটা যেন একটু eccentric প্রকৃতির ছিল। আর কিছুই নয়। নইলে নিজের অবশ্যম্ভাবী বিপদ জেনেও সে চুপ করে ছিল কেন? সুধীন বন্ধুর বিবাহে বেনারসে গেছিল বলেই, ঠিক সুহাসের মৃত্যুর সময়টাতে কলকাতায় উপস্থিত থাকতে পারেনি। যদিও তার এই অনুপস্থিতি লোকের মনে সন্দেহেরই উদ্রেক করে। এবং সুধীন আদালতে বেনারসে কেন গেছিল সে সম্পর্কেও কোন জবাব দেয়নি যা সে অনায়াসেই পারত। তারপর রায়পুর যাওয়ার দিন সুধীন যে সুহাসকে অ্যান্টিটিটেনাস ছাড়া অন্য কিছু injection দেয়নি তার প্রমাণও মালতী দেবীর statement-য়েই পাবেন। মালতী দেবী সুধীনের প্রতি এতটুকু সন্দেহযুক্তা থাকলে সুধীনকেও বাঁচতে দিতেন না। এবং শুধু তাই নয়, সুধীন যে সুহাসের হিতাকাঙক্ষী সেকথাও মালতী দেবীর চাইতে কেউ বেশী জানতেন না। তবু যে কেন আদালতে বিচারের সময় মালতী দেবী সব কথা গোপন করে গেলেন, তারও জবাব মালতী দেবীর চিঠির মধ্যে পাই।