নিশানাথ ছাড়াও আর একজন ঐ নৃশংস হত্যা-ব্যাপারে সাক্ষী থাকতে পারত, সারারাত্রি ঘুরে যে ঐ দরজায় পাহারায় নিযুক্ত থাকত, দারোয়ান ছোট্টু সিং। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দারোয়ান ছোট্টু সিং সে রাত্রে জীবিত থেকেও মরেই ছিল, প্রচণ্ড সিদ্ধির নেশার প্রভাবে। ছোট্টু সিংয়ের জবানবন্দি হতেই সেকথা আমাদের জানতে কষ্ট হয় না। কিন্তু ছোট্টু সিং যে তার জবানবন্দিতে বলেছে, তার প্রচণ্ড সিদ্ধির নেশার কথাটা কেউই জানতেন না, এ কথা সর্বৈব মিথ্যা। ছোট্টু সিংয়ের ধারণা যদিও তাই, আসলে কিন্তু ঠিক তা নয়। হত্যাকারীর পরামর্শ মতই তার সঙ্গী মানে নেশার সাথী তারিণী চক্রবর্তীই বেশী পরিমাণে ছোট্টু সিংকে সিদ্ধি-সেবন করিয়েছিল সেরাত্রে সম্ভবত। কারণ ছোট্টু সিং ও তারিণী প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় একসঙ্গে সিদ্ধির সরবত পান করত। তবে একটা ব্যাপার হতে পারে, সরবত খাবার সময় ছোট্ট সিং ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, সরবত পানের নেশার ঝোঁকে ঠিক কতটা পরিমাণে সিদ্ধি সে সরবতের সঙ্গে গলাধঃকরণ করছে। আশ্চর্য হবেন না, ব্যাপারটা আগাগোড়াই প্ল্যান-মাফিক ঘটেছে, গোড়া হতে শেষ পর্যন্ত। হত্যাকারী যখন সতীনাথের কাছে দারোয়ানের বেশে চিঠি নিয়ে যায়, তখন তার জুতোর শব্দ সুবোধ মণ্ডল শুনতে পেয়েছিল, ও কথা তার জবানবন্দিতেই প্রকাশ। এবং একমাত্র সুবোধ মণ্ডলই নয়, তারিণী চক্রবর্তীও শুনতে পেয়েছিল, তবে তারিণী জানত আসলে লোকটি কে, আর সুবোধ মণ্ডল ভেবেছিল লোকটা ছোট্টু সিং, এই যা প্রভেদ। হত্যাকারী দারোয়ানের বেশ নিয়েছিল এইজন্য যে কেউ তাকে দেখে ফেললেও যাতে ছোট্ট সিং ছাড়া অন্য কেউ না ভাবে। আসলে ব্যাপারটা যাই হোক, সতীনাথের হত্যার সময়ে একমাত্র নিশানাথ ছাড়া আর দ্বিতীয় সাক্ষী কেউ ছিল না। এবং বর্তমানে নিশানাথ যখন মৃত, তখন সামান্য ঐ নাগরা জুতো টর্চ ও অন্যান্য সাক্ষীর জবানবন্দির সাহায্যে হত্যাকারীকে ফাঁসানোনা যাবে না। সে আজ আমাদের সকলের নাগালের বাইরে। সতীনাথের হত্যাকারীর ঐ একটিমাত্র অপরাধই তো নয়, নিশানাথেরও হত্যাকারী সে। এবং সতীনাথ শিবনাথকে একই প্রক্রিয়ায় ঐ মারাত্মক টর্চ যন্ত্রটির সাহায্যে বিষাক্ত মৃত্যুবাণ নিক্ষেপ করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। সতীনাথের জন্য দুঃখ নেই। লোভীর চরম পুরস্কারই মিলেছে। দুঃখ হতভাগ্য নিরীহ অবিবেচক নিশানাথের জন্য। অবিবেচক এইজন্যই বললাম, স্নেহে ও মমতায় যদি সে অন্ধ না হত, তবে সেই child of the past কোনদিনই পরবর্তীকালে তার old game আবার শুরু করতে পারত না হয়ত এবং সুহাসের মৃত্যু হতে পর পর এতগুলো হত্যাকাণ্ডও ঘটত না।
এখন আসা যাক সেরাত্রে কিভাবে নিশানাথকে হত্যা করা হয়েছিল—নিশানাথের প্রতি মৃত্যুবাণ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল রাজাবাহাদুরের শয়নকক্ষের জানলাপথে। কারণ নিশানাথের মৃত্যুর পর মৃতদেহের position, যা এই মামলার প্রসিডিংস থেকে পড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন, কথাটার মধ্যে সন্দেহ রাখবার মত কিছুই নেই।
মৃত্যুর পূর্বে বিষজর্জরিত নিশানাথ যে স্বল্পকাল বেঁচেছিলেন তার মধ্যেই তাঁর শেষ মৃত্যু-চিৎকার শুনে মালতী দেবী ছুটে তাঁর ঘরে গিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। এবং ঠিক পূর্বমুহূর্তে অস্পষ্ট কণ্ঠে যে শেষ কথাটিমৃত্যুপথযাত্রী উচ্চারণ করেছিলেন, সেটি হত্যাকারীরই ডাকনামটি। মালতী দেবী নিজস্ব জবানবন্দিতেই সেকথা স্বীকার করেছেন দেখতে পাবেন।
নিশানাথ ও সতীনাথের হত্যার ব্যাপার শেষ করবার পূর্বে আর একটি কথা যা আপনার জানা প্রয়োজন, সতীনাথই তার অমোঘ মৃত্যুবাণ যন্ত্রের নিক্ষেপের পরিকল্পনাকারী এবং যন্ত্রটি ব্যবহারের পূর্বে তাকে অনোর এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে হয়েছিল ও তার জন্য হয়ত অনেক ড্রাইসেলের প্রয়োজন হয়েছে তার, সে-সবেরই প্রমাণ তার নিজের বাক্সেই ছিল—ইয়েসগুলো।
২.১৮ পূর্ব ঘটনার অনুস্মৃতি
এখন বোধ হয় আপনার আর বুঝতে কোনই কষ্ট হচ্ছে না, কিভাবে সুহাস, সতীনাথ ও নিশানাথকে হত্যা করা হয়। এবং সেই অদ্ভুত হত্যারহস্যটির পরিকল্পনাকারী সতীনাথের মতই আর একটি শক্তিশালী মস্তিষ্ক হতে। অর্থাৎ the real brain behind আমাদের সুবিখ্যাত প্রথিতযশা চিকিৎসক ডাঃ কালীপদ মুখার্জী, এম.ডি। যিনি আজও বহাল তবিয়তে সমাজের মধ্যে বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন এবং আমরা অনেকেই আজও যাঁকে স্বচ্ছন্দে ডেকে এনে তাঁরই হাতে আমাদের প্রিয়জনদের জীবনরক্ষাকল্পে চিকিৎসার সকল দায়িত্ব নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে তুলে দিচ্ছি। সুহাসের হত্যাব্যাপারে সত্যিকারের যে-ই অপরাধী হোক না কেন, তাকেও হয়ত ক্ষমা করা যেতে পারে, কিন্তু ডাঃ কালীপদ মুখার্জী? নৈব চ নৈব চ!
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিকই সতীনাথ ও নিশানাথের হত্যাকারী। আর সুহাসের হত্যাকারী আসলে সাঁওতাল প্রজাটি হলেও, পরিকল্পনাকারী রাজাবাহাদুর ও ডাঃ মুখার্জী ও যন্ত্র-আবিষ্কর্তা সতীনাথ।
চশমার সঙ্গে টিটেনাস রোগের বীজানু প্রয়োগে সুহাসকে হত্যার প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতেই, দ্বিতীয় প্রচেষ্টা করা হল প্লেগের বীজানু ইনজেক্ট করে।
এখন কথা হচ্ছে, সুহাসের হত্যাব্যাপারে নিরীহ ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে কেন জড়ানো হল! তার দুটি কারণ ছিল। অবিশ্যি এটাও আমার অনুমান ছাড়া কিছুই নয়। ডাঃ সুধীন যে নির্দোষ প্রমাণ আমাকে করতে হবে বলেই আমার এ শ্রমস্বীকার সে তো আপনি জানেন। সেই কথাতেই এবারে আমি ফিরে আসছি। একেবারে গোড়া হতেই শুরু করব। এ হত্যার ব্যাপারে সুধীনের বিরুদ্ধে যে প্রমাণকে আপনারা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ বলে মেনে নিয়েছেন, সেটাই সর্বপ্রথম আলোচনা করা যাক। রায়পুরে যাত্রার দিন সকালে সুধীন সুহাসকে যে ইনজেকশন দিয়েছিল, সেটা অ্যান্টিটিটেনাস্ ছাড়া আর কিছু ছিল কিনা?