সতীনাথই যে ছাতা ও টর্চের পরিকল্পনাকারী সেটা তার ঘরের ভিতরকার জিনিসপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা ফ্ল্যাট ফাইলের ভিতরকার কয়েকটি ডকুমেন্ট ও প্ল্যান থেকে আমি পরে জানতে পারি।
শেষটায় অর্থের নেশায় সতীনাথ নিশ্চয় মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। এবং তাই হয়ত এত তাড়াতাড়ি তার মৃত্যুর প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল সুবিনয়ের কাছে।
তাছাড়া সুহাসের হত্যার ব্যাপারে সতীনাথ মস্ত বড় প্রমাণ, তার বেঁচে থাকাটাও সেদিক থেকে সুহাসের হত্যাকারীর পক্ষে নিরাপদ নয় এতটুকু। কাজেই তাকে সরতে হল।
এবং বেচারী নিজের হাতের মৃত্যুবাণ নিজের বুক পেতে নিয়ে কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করে গেল।
সতীনাথেকে যখন হত্যা করা হয়, দুভাগ্যক্রমে বোধ হয় নিশানাথ সে ব্যাপারটা দেখে ফেলেছিলেন, তাই তাঁকেও হত্যা করবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল হত্যাকারীর পক্ষে একই কারণে। কুক্ষণে হতভাগ্য নিশানাথ বলে ফেলেছিলেন সকলের সামনে, black man with that big torch! তারপর তাঁর সেই কথা, that mischeivous boy again started his old game! কাজেই হত্যাকারী বুঝতে পেরেছিল এর পরও যদি নিশানাথ বেঁচে থাকেন, তাঁকে পাগল বলে রটনা করলেও সর্বনাশ ঘটতে হয়ত দেরি হয়ে না। মানুষের মন। তাছাড়া আরও একটা কথা এর মধ্যে আছে, কোন মানুষকে যখন সর্বনাশের নেশায় পায়, ধাপের পর ধাপ সে নেমেই চলে অন্ধকারের অতল গহ্বরে যতক্ষণ না সে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস নেয়। নিশানাথ বর্ণিত সেই ওল্ড গেমের কথা রাণীর চিঠি ও জবানবন্দির মধ্যেই পাবেন। তাই আর পুনরুক্তি করলাম না।
যাহোক সতীনাথের হত্যার কথাটা একবার ভেবে দেখুন: মহেশ সামন্ত, তারিণী চক্রবর্তী ও সুবোধ মণ্ডলের জবানবন্দি হতে কতকগুলো ব্যাপার অতি পরিষ্কার ভাবেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বিশেষ করে সুবোধ মণ্ডলের জবানবন্দি-যা এই কাগজের সঙ্গেই আলাদা করে আমি পাঠালাম পড়ে দেখবেন। যে রাত্রে সতীনাথ অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিহত হয়, সেরাত্রে হত্যার কিছুক্ষণ পূর্বেও সতীনাথ তার বাসাতেই ছিল। সতীনাথের বাড়ির ভৃত্যদের জবানবন্দি হতে জানা যায়, পাগড়ী বাঁধা এক দারোয়ান (?) গিয়ে সতীনাথকে একখানা চিঠি দিয়ে আসে। এবং ঐ চিঠি পাওয়ার পরই সতীনাথ বাসা হতে নিষ্ক্রান্ত হয়। এবং যাওয়ার সময় ভূত্যকে বলে যায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে আবার ফিরে আসছে। ভৃত্য বংশীর প্রথম দিকের জবানবন্দি যদি সত্যি বলে ধরে নিই, তাহলে বাসা হতে বের হয়ে আসবার ঘণ্টা দুই পূর্বে কোন এক সময় দারোয়ান-বেশী কোন এক ব্যক্তি চিঠি নিয়ে গিয়েছিল সতীনাথের কাছে।
সতীনাথের ভৃত্য বংশী গোলমাল শুনেই রাজবাড়িতে ছুটে আসে। রাজবাড়ি ও সতীনাথের বাসার দূরত্ব এমন কিছু নয়, যাতে করে বাসা থেকে বের হয়ে আসবার পর রাজবাড়িতে পৌঁছতে সতীনাথের প্রায় দুঘণ্টা সময় লাগতে পারে। তাইতেই মনে হয় আমার সতীনাথ চিঠি পেয়েই নিশ্চয় রাজবাড়ির দিকে যায়নি, আগে অন্য কোথাও গিয়েছিল, পরে রাজবাড়িতে যায়। এবং তা যদি হয় তো, আমার অনুমান মৃত্যুর পূর্বে সতীনাথের রাজবাড়ির বাইরে অন্য কোন জায়গায় হত্যাকারীর সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা বা কথাবার্তা হয়েছিল এবং সেই সময় সতীনাথের পকেট থেকে চিঠিখানি খোয়া যায়। কিন্তু ভৃত্য বংশীর কথায়ও আমি তেমন আশ্বাস স্থাপন করতে পারছি না। কারণ প্রথমে একবার সে বলেছে—এই ঘণ্টা দুইও হবে না কে একটা লোক বাবুর কাছে চিঠি নিয়ে গিয়েছিল, আবার পরমুহূর্তে জেরায় বলেছে লোকটা বের হয়ে আসবার মিনিট পনের-কুড়ির মধ্যেই বংশী গোলমাল শুনে ছুটে আসে।
এখন কথাটা হচ্ছে, বংশীর জবানবন্দির মধ্যে কোন্ কাথাটা সত্যি! প্রথম না দ্বিতীয়! আমি বলব দ্বিতীয় নয়, প্রথম কথাটাই। তার কারণ ১নং মৃত সতীনাথের পায়ে যে জুতো ছিল তার মধ্যে নরম লাল রংয়ের এঁটেল মাটি লেগেছিল। যেটা পরের দিন ময়নাঘরে ময়নাতদন্তের সময় সুব্রত উপস্থিত হয়ে দেখতে পায়। ২নং সতীনাথের বাসা থেকে রাজবাড়ির রাস্তায় কোথাও ঐ সময় কোন লাল রংয়ের এঁটেল মাটির অস্তিত্বই ছিল না। ৩নং যে নাগরা জুতোটা পাঠিয়েছি তার সোলেও লাল এঁটেল মাটি দেখতে পাবেন। নদীর ধারে লাল রঙের এঁটেল মাটি একমাত্র ঐ শহরে আছে আমি দেখেছি। তাতে করে আমার মনে হয় বংশী প্রথমটাই সত্যি বলেছিল। ঐ রাত্রে মৃত্যুর পূর্বে সতীনাথের হত্যাকারীর সঙ্গে নদীর ধারে দেখা হয়েছিল এবং কথাবার্তাও হয়েছিল নিশ্চয়ই,এই আমার বিশ্বাস। এবং প্রায় একই সঙ্গে দুজনে অল্পক্ষণ আগেপিছে রাজবাড়িতে প্রত্যাবর্তন করে। খুব সম্ভব অন্দরমহলের আঙিনায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই হত্যাকারী সতীনাথকে অতর্কিতে সামনের দিক থেকে তারই তৈরী মৃত্যুবাণ নিক্ষেপ করে হত্যা করে। এবং হত্যা করেই সতীনাথের চীৎকারের সঙ্গে সঙ্গেই হত্যাকারী বাড়ির মধ্যে গিয়ে আত্মগোপন করে। তারপর সময় বুঝে আবার অকুস্থানে আবির্ভূত হয়। হত্যার দিন রাত্রে অস্পষ্ট চাঁদের আলো ছিল। সেই আলোতেই নিশানাথ তাঁর শয়নকক্ষের খোলা জানালাপথে ঘটনাচক্রে সমগ্র ব্যাপারটি হয়ত দেখতে পান। সতীনাথের প্রতি মৃত্যুবাণ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল মারাত্মক ঐ টর্চ যন্ত্রটিরই সাহায্যে, এবং নিশানাথ সে ব্যাপার দেখে ফেলেছিলেন বলেই বলেছিলেন—black man with that big torch! এবং আগেই বলেছি ঐ স্বগত উক্তিই হল তাঁর মৃত্যুর কারণ।