ওর মেকানিজম এত সূক্ষ্ম ও চমৎকার যে যন্ত্রটির শেষে ছোট যে রবারের ক্যাপটি আছে, ওতে চাপ পড়লেই যন্ত্রটি থেকে ভিতরকার তরল পদার্থ প্রেসারে বের হয়ে সিরিঞ্জের মত যন্ত্রের অগ্রভাগের সঙ্গে যুক্ত নিড-পথে বের হয়ে আসবে। ছাতাটি খুলে ভাল করে পরীক্ষা না করে দেখা পর্যন্ত এসব কিছুই কারও নজরে পড়তে পারে না।
সত্যি ঐ অত্যাশ্চর্য যন্ত্রের পরিকল্পনাকারী, আমাদের চোখে যেই হোক না কেন, I take my hats off! সংবাদপত্রে রায়পুরের হত্যা-সংক্রান্ত ঘটনাবলী পড়তে পড়তে ঐ ছাতার কথা শোনা অবধি আমার মনে একটা খটকা লেগেছিল। কেন যেন আমার মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই ঐ ছাতার মধ্যে কোন একটা গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। আসলে সুহাসের হত্যার ব্যাপারে ছাতাটি প্রাইমারি, সেকেণ্ডারি ঐকালোলোকটি। রায়পুরের প্রাসাদে যে রাত্রে সুবিনয়ের কাকা শ্রীযুক্ত নিশানাথ নিহত হন সেই রাত্রে তদন্তে গিয়ে সুবিনয়ের কক্ষে প্রবেশ করে, প্রথমেই যে দুটি অন্যের দৃষ্টিতে ও বিচারে অতি সাধারণ (?) বস্তু, আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে হচ্ছে ১নং ছাতাটি এবং ২নং দেওয়ালে ঝোলানো একটি পাঁচ-সেলের হান্টিং টর্চ।
আপনি হয়ত এখনই প্রশ্ন করবেন, সর্বাগ্রে কেন ঐ বস্তু দুটিই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল?
তার জবাবে বলব, রায়পুরের ধনশালী ও শৌখীন রাজাবাহাদুরের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে আর যাই লোকে আশা করুক না কেন, আলমারির মাথায় তুলে রাখা সামান্য পুরাতন একটি ছাতা দেখবার আশা নিশ্চয়ই কেউ করে না বা করতে পারে না। তাই আলমারির মাথায় রাখা ঐছাতাটি আমার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল এবং যে বাড়ির ঘরে ঘরে ডায়নামোর সাহায্যে সারারাত্রি আলো জ্বালাবার সুব্যবস্থা আছে এবং যার কোনদিনই শিকারের কোন বাতিক বা হবি নেই, তার ঘরে হঠাৎ পাঁচ-সেলের হান্টিং টর্চের বা কি এমন প্রয়োজন থাকতে পারেতাই দেওয়ালে ঝোলানো পাঁচ-সেলের হাষ্টিং টচটাও আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। চিরদিনই কোন ব্যাপারে মনে যখন আমার বিন্দুমাত্রও সন্দেহের ছায়াপাত হয়, সে ব্যাপারের খুঁটিনাটি পর্যালোচনা করে নিজের মনকে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি সন্তুষ্ট করতে পারি, আমি স্থির থাকতে পারি না। সে যাই হোক, মনের সন্দেহের নিরবসানের জন্যই পরের দিন সর্বপ্রথম বিকাশের সাহায্যে উক্ত বস্তু দুটি আমি রায়পুরের রাজবাটি থেকে সবার অলক্ষ্যে সংগ্রহ করে আনি। এবং আমার সন্দেহ যে অমূলক নয়, সেটাও সহজে প্রমাণিত হয়ে যায়। কি করে ছাতা আর টচটা সংগ্রহ করেছি, সে-কথা আর নাই বা বললাম। সাদা কথায় শুনিয়ে রাখি, জিনিস দুটি চুরি করিয়ে এনেছি এবং ঐ ছাতা ও টর্চের রহস্যের উদঘাটিত হবার পরই আর কালো লোকটির সন্ধানের প্রচেষ্টা ত্যাগ করি। ছাতাটি পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন, কি উপায়ে হতভাগ্য সুহাসের দেহে প্লেগ-বীজাণু প্রবেশ করানো হয়েছিল।
এবারে আসা যাক পাঁচ-সেলের হাষ্টিং টচটির কথায়। টচটি পরীক্ষা করলেই দেখতে পাবেন, টর্চের আকার হলেও আসলে ওটি টর্চ নয়। টর্চের যেখানে আলোর বা লাগোনো থাকে, সেখানে দেখুন একটি গোলাকার ছিদ্রপথ আছে। এবং বাতির পিছনকার ক্যাপটি খুলুন, দেখবেন ভেতরে একটি এক-বিঘত পরিমাণ সরু পেনসিলের মত ইস্পাতের নল বসানো আছে। ঐ জিনিসটির খোলর মধ্যে তিনটি ড্রাই সেল ভরা যায়। এবং টর্চের বোতাম টিপলেই, সেলের কারেন্টে আলো জ্বালার পরিবর্তে ঐ সরু নলের ভিতর থেকে প্রচণ্ড গতিতে একটি সরু ইস্পাতের তৈরী তীর বের হয়ে মুখের ছিদ্রপথ দিয়ে ছুটে সামনের দিকে নিক্ষিপ্ত হয়। তাই বলছিলাম, আসলে দেখতে বস্তুটি পাঁচ-সেলের একটি হান্টিং টর্চের মত হলেও, তীর নিক্ষেপের ওটি একটি চমৎকার যন্ত্রবিশেষ। এবং ঐ যন্ত্রের সাহায্যেই সতীনাথ লাহিড়ী ও নিশানাথ মল্লিককে হত্যা করা হয়েছে। ঐ ছাতা ও টর্চের উদ্যোক্তা ও পরিকল্পনাকারী হচ্ছে স্বয়ং সতীনাথ লাহিড়ী। হতভাগ্য তার নিজের মৃত্যুবাণ নিজ হাতেই তৈরী করে দিয়েছিল। সতীনাথের সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানতে পেরেছি, সতীনাথ ছিল একজন মেধাবী বিজ্ঞানের ছাত্র। সৎকাজে তার বুদ্ধিকে পরিচালিত করতে পারলে আজ দেশের অনেক উপকারই তার দ্বারা হত। কিন্তু যে বুদ্ধি ভগবান তার মস্তিষ্কে দিয়েছিলেন, তার অপব্যবহারেই তার অকাল মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে তার প্রতিভার শোচনীয় পরিসমাপ্তি ঘটালো।
সতীনাথের জীবনকথা সংগ্রহ করে আমি যতটুকু জেনেছি তা এই ছোটবেলা হতেই নাকি সতীনাথের সায়েন্সের দিকে প্রবল একটা ঝোঁক ছিল। নানাপ্রকারের যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রায় সময়ই সে নাড়াচাড়া করত। লাহিড়ী একটা ছোটখাটো ইলেকট্রিক কারখানা করে চেতলা অঞ্চলে কাজ করত। একবার মধ্যরাত্রে ঐ কারখানার সামনে হঠাৎ সুবিনয়ের গাড়ি ইলেকট্রিক সংক্রান্ত ব্যাপারে বিগড়ে যায়। সতীনাথ গাড়ি মেরামত করে দেয়। এই সূত্রেই সুবিনয়ের সঙ্গে আলাপ সতীনাথের। বলাই বাহুল্য, সতীনাথ ঐ সামান্য ঘটনার মধ্য দিয়েই সুবিনয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ক্রমে দুজনের মধ্যে গভীর আলাপ জমে ওঠে। সতীনাথ কারখানায় তালা লাগিয়ে দিয়ে একেবারে সুবিনয়ের সেক্রেটারী পদে নিযুক্ত হয়। সুহাসকে হত্যা করার ফন্দি আঁটছিলেন সুবিনয় অনেকদিন ধরে। সতীনাথকে পেয়ে ভেবেছিলেন সতীনাথের সাহায্যে কাজ হাসিল করে নেবেন; অর্থাৎ তার মাথায় সাদা কথায় কাঁঠাল ভাঙবেন। কিন্তু সতীনাথ যে অত নিরীহ বোকা নয়, সে-কথা বুঝতে হয়ত সুবিনয়ের খুবি বেশী দেরি হয়নি। তাই সতীনাথের ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সটা ক্রমে স্ফীত হয়ে উঠতে থাকে। সতীনাথের ঘর থেকে সুব্রত যেসব কাগজপত্র উদ্ধার করেছিল সেগুলিই তার প্রমাণ দেবে নিঃসংশয়ে। সতীনাথ কিন্তু ওর আসল নাম নয়-ছদ্মনাম। আসল নাম শ্রীপতি লাহিড়ী। যা হোক, সুহাসের হত্যার ব্যাপারে সতীনাথের তৈরী অস্ত্র ও ডাঃ মুখার্জীর সংগৃহীত প্লেগ বীজাণু কাজে লাগানো হয়।