সেখানে গিয়ে দিন-দশেকের মধ্যেই যে কি উপায়ে আমি একটি প্লেগ কালচার টিউব হস্তগত করি সে-কথা আর বলব না, তবে এইটুকু বলছি, একটি টিউব সংগ্রহ করে সেই রাত্রেই বম্বে মেলে আমি রওনা হই। কলকাতায় পৌঁছেই টিউবটা আমি ডাঃ মুখার্জীকে দিই, তিনিও আমায় পাঁচহাজার টাকা নগদ হাতে হাতে তখুনি দিয়ে দেন। তবে এ-কথা আমি অকপটে স্বীকার করছি, যদি আগে ঘুণাক্ষরেও আমি জানতে পারতাম কিসের জন্য ডাঃ মুখার্জী আমাকে দিয়ে প্লেগ কালচার টিউব সংগ্রহ করেছিলেন, তাহলে নিশ্চয়ই আমি এই হীন কাজে হাত দিতাম না। পরে যখন আসল ব্যাপার জানতে পারলাম, তখন আমার অনুশোচনার আর অবধি পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু তখন নিজের মাথা বাঁচাতে সবই গোপন করে যেতে হল। পরে নিরন্তর সেই কথাটাই আমার মনে হয়েছে, ডা সুধীন চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের জন্য সর্বাংশে না হলেও অনেকাংশেই দায়ী আমি হয়ত। আজ তাই কিরীটীবাবুর অনুরোধে সব কথা লিখেই দিলাম। এর জন্য যে কোন শাস্তিই আমি মাথা পেতে নিতে রাজী আছি, তবু নিদোষ ডাঃ সুধীন চৌধুরী কলঙ্কমুক্ত হোন এই চাই। আজ যদি তিনি মুক্তি পান, তবে হয়ত এই মহাপাপের যার সঙ্গে পরোক্ষে আমি ভাগ্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছি তার কিছুটা প্রায়শ্চিত্তও আমার করা হবে। ইতিডাঃ অমর ঘোষ।
ডাঃ অমর ঘোষের স্বীকৃতি পড়লেন তো! নিশ্চয়ই কাগজে দেখে থাকবেন, গত পরশু অর্থাৎ ঐ বিবৃতি দেবার দুদিন পরেই তিনি সুইসাইড করেছেন হাই ডোজে মরফিন নিয়ে। যা এখন বোধ হয় বুঝতে পারছেন, কেমন করে কি উপায়ে প্লেগ-ব্যাসিলি সংগৃহীত হয়েছিল। ডাঃ অমর ঘোষের সাহায্যে প্লেগ কালচার সংগ্রহ করে ডাঃ মুখার্জী সেই বিষ সুহাসের শরীরে প্রবেশ করালেন। কিন্তু দুঃখ এই, ডাঃ ঘোষের স্বীকৃতির পরও ডাঃ মুখার্জীকে আমরা ধরতে পারব না, কারণ যে যে পরিচিতিপত্র তিনি কর্নেল মেননকে দিয়েছিলেন সেটার অস্তিত্ত্ব আজ ইহজগতে আর নেই। সম্ভবত বহু অর্থের বিনিময়ে কর্নেল মেনন সেটাকে ভস্মীভূত করেছেন এবং আমার যথাসাধ্য চেষ্টাসত্ত্বেও সেই পরিচিতিপত্র সম্পর্কে কর্নেল মেনন তাঁর সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, কোন পত্রই তিনি নাকি ডাঃ মুখার্জীর কাছ হতে পাননি, কেবলমাত্র ডাঃ ঘোষের মৌখিক অনুরোধেই তিনি ডাঃ ঘোষকে ইনস্টিটিউটে কাজ করতে সম্মতি দিয়েছিলেন। ডাঃ ঘোষ কর্নেল মেননের কাছে এসে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, ডাঃ মুখার্জী তাঁকে প্লেগ ইনস্টিটিউটে কয়েকদিন কাজ করবার জন্য পাঠিয়েছেন। এবং কর্ণেল মেনন নাকি তাঁর বন্ধু। ডাঃ মুখার্জীর মৌখিক অনুরোধ রক্ষা করেই ডাঃ অমর ঘোষকে ইনস্টিটিউটে প্রবেশাধিকার দেন এবং রায়পুর হত্যা-মামলার জবানবন্দি দিতে গিয়ে বিচারালয়ে কর্নেল মেনন সেই কথাই বলে এসেছেন। তিনি সেদিনও যে কথা বলেছিলেন, আজও তাই বলছেন, এর বেশী তাঁর বলবার মত কিছুই নেই। এরপর আর কর্নেল মনেনকে আমি দ্বিতীয় প্রশ্ন করি নি। কারণ জানতাম, কর্নেল মেননের মত একজন সম্মানী সরকারী উচ্চপদস্থ ব্যক্তি আর যাই করুন না কেন, যে ভুল একবার করে ফেলেছেন এবং যে ভুলের আজ সংশোধন করতে গেলে তাঁর এতদিনকার সম্মান প্রতিপত্তি সব ধূলায় লুষ্ঠিত হবে সেই ভয়েই আজ তাঁকে এমনি করে সর্ব ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানাতেই হবে। তাছাড়া অর্থের লোভকে কাটিয়ে ওঠবার মত মানসিক বলও তাঁর নেই। বিদ্যা তাঁকে ডিগ্রী দিলেও বিদ্যার গৌরব দেয়নি। কর্নেল মেননের কথা এখানেই থাক।
যাহোক তাহলে এখন আমরা ধরে নিতে পারি অনায়াসেই যে, নির্বিবাদে ডাঃ ঘোষের মারফতই বম্বে থেকে এক টিউব প্লেগ কালচার ডাঃ মুখার্জীর হাতে পৌঁছেছিল।
এবারে আসা যাক—the blackman with the black umbrella-র রহস্যে। আমার মনে হয় আদালতে বিচারের সময় এই point-টাতে আপনারা তেমন গুরুত্ব দেননি। সুহাস মল্লিক যেদিন শিয়ালদহ স্টেশনে অসুস্থ হয়ে কালোলোকটির ছাতার খোঁচা (?) খেয়ে এবং আমার মতে যে সময় হতভাগ্য সুহাসের দেহে প্লেগ-বীজাণু inject করা হয়, সেদিনকার সেই ঘটনাটা যেন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করা হয়নি, অর্থাৎ সেই অচেনা কালো ছত্রধারীলোকটির movement-টাযেভাবে ঠিক অনুসন্ধান করা উচিত ছিল, আদালতে সেভাবে করা হয়নি। যদিও ঐ ছত্রধারী লোকটিকে কেবলমাত্র সুহাসের হত্যা-ব্যাপারে একটা যন্ত্র হিসাবেই কাজে লাগানো হয়েছিল। এবং যদিও আসলে উক্ত লোকটি এই দুর্ঘটনায় সামান্য একটি পার্শ্বচরিত্র মাত্র, তথাপি লোকটিকে অন্তত খুঁজে বার করবার চেষ্টা করাও। আপনাদের খুবই উচিত ছিল না কি? তর্কের খাতিরেও নিশ্চয়ই এখন সেকথা অস্বীকার করতে পারবেন না, কি বলেন? কিন্তু যাক সেকথা, যা ঘটনাচক্রে হয়ে ওঠেনি, এখন আর সেটার পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের হত্যা-মামলার সেই রহস্যময় কালো লোকটিকে আর ইহজগতে জীবিত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না।
তবে সেই লোকটি, যে কালো ছাতাটি ব্যবহার করেছিল, সেটা আমি উদ্ধার করেছি। সেটা আপনাকে পাঠানো হল, পরীক্ষা করে দেখবেন।
এই ছাতার ব্যাপারেও হত্যাকারী তার অসাধারণ বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিরই পরিচয় দিয়েছে। ছাতার একটি শিকের সঙ্গে দেখবেন চমৎকারভাবে দেখতে অবিকল প্রায় একটি ছোট হাইপোডারমিক সিরিঞ্জের মত একটা যন্ত্র লাগানো আছে। ঐ সিরিঞ্জের মত যন্ত্রের ভিতরেই ছিল সংগুপ্ত প্লেগের জীবাণু।