এতদিনে সুবিনয়ের পীত বিষের ক্রিয়া শুরু হল।
আবার একটা কথা এসে পড়ছে, সুবিনয় কি জানতেন সুরেন চৌধুরী আসলে নিহত হননি? আমার কিন্তু মনে হয়, হ্যাঁ, তিনি এ কথা বোধ হয় জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু জানতে পারলে কি হবে, তাঁর তখন সাপের ছুঁচো গেলবার মত অবস্থা অনেকটা। এবং সম্ভবত দুটি কারণে সুবিনয় মুখ খুলতে পারেননি। প্রথমত এতদিন পরে যদি লোক জানতে পারে আসলে সুরেন চৌধুরী মরেননি, তাহলে মল্লিকবংশের সম্মান গৌরব সব ধূলায় লুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয়ত এই রহস্যের উদঘাটনের সঙ্গে সঙ্গে বংশের অনেক কলঙ্ক-কাহিনীই আর চাপা থাকবে না। এবং এ কথাও সেই সঙ্গে প্রমাণিত হবে রসময়ই শ্ৰীকণ্ঠ ও সুরেনের হত্যার উদ্যোক্তা। কাজেই বেচারাকে চুপ করে বিষ হজম করতে হয়েছে।
জাস্টিস মৈত্র যেন অবাক হয়ে যান। একটা কঠিন রহস্যের গোলকধাঁধায় যেন কিরীটী তাঁকে ঘুরিয়ে নিয়ে চলেছে। সত্যি, এ রহস্যের কিনারা কোথায়? ভাবেন কেমন করেই বা কিরীটী কঠিন রায়পুর হত্যারহস্যের মীমাংসায় গিয়ে পৌঁছাল? কোন্ পথ ধরে? অদ্ভুত বিচার-বিশ্লেষণ শক্তি লোকটার!
দীর্ঘদিন ধরে বিচারালয়ে বাদী ও বিবাদী পক্ষের জেরা ও জবানবন্দি নিয়ে এতগুলো লোকের সম্মিলিত বিচারশক্তি দিয়ে যে অপরাধের মীমাংসায় পৌঁছনো গেল, অলক্ষ্যে যে তার মধ্যে এত বড় গলদ থেকে গেল দৃষ্টি এড়িয়ে, ব্যাপারটা শুধু আশ্চর্যই নয় অভূতপূর্ব যেন।
ডাঃ সুধীন চৌধুরী সুহাস মল্লিকের হত্যাকারী নয়?
সত্যি মানুষের সাধারণ বিচারবুদ্ধি বাইরেও যে কত অমীমাংসিত জিনিস থেকে যায়, ভাবতেও আশ্চর্য লাগে!
প্রমাণ—প্রমাণই আমাদের বিচারে সব চাইতে বড় কথা।
মন যেখানে বলছে সেটা সত্যি নয়, ভুল, মিথ্যা—সেখানেও তো নিছক আমাদের মনগড়া কতকগুলো প্রমাণের দোহাই দিয়েই কত সময় আমরা আমাদের বিচারের মীমাংসা করে নিই।
বিবেক বলে কি তবে কিছুই নেই? মানুষের মন হল মিথ্যা, আর সামান্য প্রমাণই হল সত্যি?
জাস্টিস মৈত্র আবার কিরীটীর চিঠিতে মনঃসংযোগ করেন। রসময়ের রক্তের সঙ্গেই রায়-গোষ্ঠীতে এসেছিলবেনোজল। এবারে আবার সেইবেনোজলের স্রোতে ফিরে আসা যাক!
রসময়ের মৃত্যুর পর সুবিনয় মিল্লক গদীতে আসীন হলেন।
কিন্তু যে অর্থের লালসায় তিনি তাঁর জন্মদাতা পিতাকেও বিষপ্রয়োগে হত্যা করতে পর্যন্ত দ্বিধা করেননি, এবার সেই লালসার মুখে বাধা হল তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই হতভাগ্য সুহাস। সুহাস অন্ধের মত তার দাদাকে যতই ভালবাসুক না কেন, সুবিনয়ের মনে সুহাসের জন্য এতটুকু স্নেহও হয়ত কোথাও ছিল না। ছোটবেলা থেকেই সুবিনয় সুহাসকে সম্পত্তির ভাগীদার হিসাবে দেখে এসেছে। ক্রমে সেটাই প্রবল হিংসায় পরিণত হয়। এবারে সুবিনয় সুযোগের সন্ধানে ফিরতে লাগলেন, কি করে সকলের সন্দেহ বাঁচিয়ে সুহাসকে তাঁর পথ হতে সরাবে ঐ চিন্তাই হল তাঁর আসল চিন্তা। ঐভাবেই সুহাসের হত্যারহস্যের হল গোড়াপত্তন। অতীত থেকে আমরাও এবারে ফিরে যাব বর্তমান রায়পুর হত্যা-মীমাংসায়।
২.১৭ মীমাংসা
কিরীটীর চিঠি,–
রসময়ের মৃত্যুর পর সুবিনয় অল্পদিনের মধ্যেই জমিদারী সেরেস্তায় আমূল পরিবর্তন ঘটান।
প্রথমেই আনলেন তিনি সতীনাথ লাহিড়ীকে। তারপর হাত করলেন তারিণী চক্রবর্তীকে। এবং সর্বশেষে আমাদের ডাঃ কালীপদ মুখার্জীকে।
কালীপদ মুখার্জী একজন প্রথিতযশা চিকিৎসক। চিকিৎসক হিসাবে বহু অর্থও তিনি জমিয়েছেন। তথাপি কেন যে তিনি অর্থের লোভে নৃশংস-হত্যার মধ্যে তাঁর চিকিৎসাবিদ্যাকে জড়িয়ে নিজেকে এবং এত বড় সম্মান ও গৌরবের বস্তু চিকিৎসাশাস্ত্রকে কলঙ্কিত করলেন, তার সদুত্তর একমাত্র হয়ত তিনিই দিতে পারেন। বিচারের চোখে আজ তিনি কলঙ্কমুক্ত হলেও, মানুষ হিসাবে আমরা কেউ তাঁকে ক্ষমা করতে পারি না। সুহাসের হত্যাপরাধে যদি কারও মৃত্যুদণ্ড হয়, তবে সর্বাগ্রে তাঁরই হওয়া উচিত। কিন্তু যা সে কথা, যা বলছিলাম, টাকার লোভে ডাঃ কালীপদ মুখার্জী এসে সুবিনয়ের সঙ্গে হাত মেলালেন। প্রথমে টিটেনাস রোগের বীজাণু প্রয়োগে হত্যা করবার চেষ্টা যখন ঘটনাচক্রে ব্যর্থ হল, শয়তান ডাক্তার তখন সুহাসের শরীরে প্লেগের জীবাণু ইনজেক্ট করে হত্যা করবার মনস্থ করলেন। মুখার্জী তাঁর সহকারীও রিসার্চ-স্টুডেন্ট ডাঃ অমর ঘোষকে বম্বেতে পাঠালেন প্লেগ কালচার নিয়ে আসতে।
ডাঃ অমর ঘোষ তাঁর যে জবানবন্দি আমার কাছে দিয়েছেন তা পাঠিয়ে দিলাম।
আমি ডাঃ অমর ঘোষ স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিচ্ছি: ডাঃ মুখার্জীর অনুরোধে আমি বম্বে প্লেগ রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি নাকি প্লেগ ব্যাসিলি সম্পর্কে কি একটা জটিল রিসার্চ করছেন এবং তার এক টিউব প্লেগ কালচার চাই। তিনি এও আমাকে বলেন, প্লেগ কালচার নিয়ে যে তিনি কোনো রিসার্চ করছেন একথা একান্তভাবে গোপন রাখতে চান। কারণ তাঁর এক্সপেরিমেন্ট সম্পূর্ণ হওয়ার আগে এ কথা কেউ জানুক এ তাঁর মোটেই অভিপ্রেত নয়।
রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ কর্নেল মেনন তাঁর বিশেষ পরিচিত এবং তাঁকে বললে সুবিধা হতে পারে, তথাপি তিনি তাঁকেও সে কথা বলতে চান না। আমি যদি কোন উপায়ে গোপনে একটি প্লেগ কালচার টিউব বম্বে থেকে নিয়ে আসতে পারি সকলের অজ্ঞাতে তাহলে তিনি বিশেষ বাধিত হন। শুধু যে তাঁর কথাতেই আমি রাজী হয়েছিলাম তা নয়, ঐ সময় আমার অর্থেরও বিশেষ প্রয়োজন হয়। অর্থের কোন সুরাহাই যখন করে উঠতে পারছি না, তখন একদিন হঠাৎ ডাঃ মুখার্জী আমাকে ডেকে বলেন, যদি কোন উপায়ে বম্বে থেকে একটি প্লেগ কালচার টিউব আমি এনে দিতে পারি, তিনি আমাকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা দেবেন এবং ব্যবস্থা সব তিনিই করে দেবেন। অর্থপ্রাপ্তির আশু কোন উপায় আর না দেখে, শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রস্তাবেই আমি সম্মত হই এবং কর্নেল মেননএর কাছে তাঁর পরিচিতিপত্র নিয়ে আমি বম্বেতে রওনা হই।