একটা বন্দী দৈত্য যেন হঠাৎ ছাড়া পেয়ে হুঙ্কার দিয়ে ফিরছে দিকে দিকে।…তারই ভয়াবহ তাণ্ডব উল্লাস!
সুধীন মোমবাতিটার দিকে তাকিয়ে আছে, বন্ধ দরজার মধ্যবর্তী সামান্য ফাঁক দিয়ে বাইরের ঝোড়ো হাওয়া এসে মাঝে মাঝে মোমবাতির শিখাটাকে ঈষৎ কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মার মুখের ওপরে ডান দিকটায় মোমবাতির মৃদু আলোর সামান্য আভাস। মা বলতে লাগলেন। সেই করুণ হৃদয়দ্রাবী কাহিনী, আজও সে দিনটার কথা আমি ভুলতে পারিনি সুধী। তারও আগের রাত্রে এমনি ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। কিসের যেন একটা অস্বোয়াস্তিতে সারাটা রাত আমি ঘুমোতে পারলাম না। যতবার দু চোখের পাতা বোজাই, একটা না একটা বিশ্রী দুঃস্বপ্ন দেখে তন্দ্রা ছুটে যায়। ভোরবেলাতেই শয্যা ছেড়ে উঠলাম, সারাটা রাত্রি ঘুমোতে পারিনি, শরীরটা বড় ক্লান্ত। বেলা দশটার সময় তোমার বাবার রক্তাক্ত, প্রায় দ্বিখণ্ডিত ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহখানি নিয়ে এসে রাজবাড়ির সান-বাঁধানো উঠোনের ওপরে নামাল বাহকেরা। একটা সাদা রক্তমাখা চাদরে দেহটি ঢাকা আগাগোড়া। তোমার দাদামশাই রাজা রসময় মল্লিক বারান্দার ওপরে দাঁড়িয়েছিলেন; তাঁরই নীরব আদেশে কে একজন যেন এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে নিলে। সে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ ও প্রায় দেহচ্যুত ক্ষতবিক্ষত মস্তকটি দেখে তোমার পিতা বলে আর তাঁকে চেনবারও তখন উপায় ছিল না। আমি চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। তিনদিন পরে যখন জ্ঞান হল, চেয়ে দেখি তুই তোর মামার কোলে বসে, আমাকে ঠেলা দিয়ে ডাকছিস মা মা বলে।
মা চুপ করলেন, চোখের কোলে সুস্পষ্ট অশ্রুর আভাস—মোমবাতির আলোয় চিকচি করছে।
বাইরে তেমনি বৃষ্টির শব্দ, দৈত্যটা তেমনি হুঙ্কার দিয়ে ফিরছে একটানা।
ইতিমধ্যে মোমবাতিটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে প্রায় তলায় এসে পৌঁছেছে।
।ঘরের ভিতরে মৃত্যুর মত একটা অস্বাভাবিক স্তব্ধতা। বুকের ভিতরটা যেন কেমন খালি খালি মনে হয়।
মা আবার বলতে লাগলেন, তার পরদিনই, এইটুকু তোকে বুকে করে চলে এলাম দাদার আশ্রয়ে। কিন্তু মনে আমার শান্তি মিলল কই? কতদিন ঘুমের ঘোরে দেখেছি, তাঁর অতৃপ্ত দেহহীন আত্মা যেন আমার চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি জানি এর মধ্যে কোথাও একটা কূটচক্রীর চক্রান্ত আছে। ভুলিনি আমি কিছুই। সেদিন হতেই বুকের মধ্যে দিবারাত্র জ্বলছে তুষের আগুন। আর এও জানি, চিতায় না শোয়া পর্যন্ত এ আগুন কোনো দিন আর নিভবে না।
তোকে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না বাবা, সে ব্যথা যে কত বড় দুঃসহ ও মর্মান্তিক! এতদিন তোকে আমি এ-কথা বলিনি, কেবল নিজের বুকের মধ্যে চেপে চেপে গুমরে মরেছি, কিন্তু এখন তুই বড় হয়েছিস বাবা, এ কথা হয়ত তুই কানাঘুষায় শুনেছিসও, কিন্তু বু আমাকে প্রশ্ন করিসনি। আর তোর কাছ থেকে চেপে রাখা উচিত নয় বলেই আজ তোকে সবই বললাম, যারা এতবড় মর্মান্তিক অভিশাপ আমার ওপরে তুলে দিয়েছে তাদের যেন তুই ক্ষমা করিস না।
মা চুপ করলেন। এরপর সেরাত্রে মা ও ছেলে কেউই ঘুমোতে পারেনি। কারও চোখের পাতাতেই ঘুম আসেনি। ঐ মাত্র একটি দিনই মার মুখে সুধীন শুনেছিল বাবার কথা,আর কোনোদিনই শোনেনি।
সেই ঝড়জলের রাত্রি ছাড়া আজ পর্যন্ত ও সম্পর্কে মা আর ওকে কোনো কথাই বলেননি। এবং সেদিন মার ঐ কাহিনীর মধ্য দিয়েই সুধীন বুঝেছিল, মল্লিক-বাড়ির প্রতি কী অবিমিশ্র। ঘৃণা ও ক্রোধ আজও তার মার সমগ্র বুকখানাকে ভরে রেখেছে!…
নিষ্ফল আক্রোশে অহনিশি মার মনে কী দুবার দ্বন্দ্ব! এবং সেইদিন থেকে সে নিজেও মল্লিক-বাড়ির যাবতীয় স্পর্শকে বাঁচিয়ে এসেছে কতকটা ইচ্ছে করেই যেন এবং মনের মধ্যে বরাবর পোষণ করে এসেছে একটা তীব্র ঘৃণা। অলক্ষ্যে বসে বিধাতা হয়ত হেসেছিলেন, তাই পিতার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মাতুলগোষ্ঠীর যে যোগসূত্রটা চিরদিনের মত ছিন্ন হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল, সেই ছিন্নসূত্র ধরে দীর্ঘদিন পরে টান পড়ল সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ব্যাপারটা ঘটেছিল সুধীনেরই ফোর্থ ইয়ারে মেডিকেল কলেজে পড়বার সময়। একদিন রাত্রে আউটডোরে সুধীন যখন ডিউটি দিতে ব্যস্ত এমন সময় খেলার মাঠ থেকে মাথায় পট্টি বেঁধে সুহাস আউটডোরে এল।
রুগ্ন লম্বা ধরনের ছেলেটি। কৈশোরের সীমা পেরিয়ে সবে তখন যৌবনে পা দিয়েছে সে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রং, বাঁশীর মত টিকালো নাসা, ফোঁটা ফুলের মতই সুন্দর ঢলঢল মুখখানি। ঠোঁটের ওপরে সবে গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। দেখলেই যেন মনে জাগে একটা স্নেহের আকর্ষণ।
খেলার মাঠে বিপক্ষ দলের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় ক্রমে বচসা হতে হতে হাতাহাতি ও মারামারিতে পরিণত হয়। ডানদিককার কপালে প্রায় দুই ইঞ্চি পরিমাণ একটি ক্ষত-চিহ্ন।
বাড়িতে মার কাছে বকুনি খাওয়ার ভয়ে সুহাস গাড়ি নিয়ে সোজা ময়দান থেকে একেবারে মেডিকেল কলেজে চলে এসেছে ড্রেসিং করাতে।
সুধীন গোটাতিনেক স্টি দিয়ে পট্টি বেঁধে দিল।
এবং সেই সূত্রে ইমার্জেন্সি রুমেই দুজনের মধ্যে প্রথম আলাপের সূত্রপাত হল। ক্রমে সেই সামান্য আলাপকে কেন্দ্র করে গভীর হয়ে উঠতে লাগল পরস্পরের সৌহার্দ্য। এত মিশুঁকে সুহাস যে দু-চার দিনেই সুধীনকৈ আপন করে নিতে তার কোনো কষ্টই হয়নি। এবং সবচাইতে মজা এই যে, তখনও কিন্তু সুধীন সুহাসের আসল পরিচয়টুকু জানতে পারেনি।