এমন সময়ে রঙ্গমঞ্চে এসে দাঁড়ালেন সুধীনের পিতা হতভাগ্য নির্বিরোধী সুরেন চৌধুরী।
শ্রীকন্ঠের দ্বিতীয় উইল রসময় শ্রীকণ্ঠকে হত্যার পূর্বেই সরিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, শ্ৰীকণ্ঠ দ্বিতীয়বার উইল করেছেন এ কথা রসময় জানতে পারলেন কি করে? ব্যাপারটা
তো আগাগোড়াই অত্যন্ত গোপন করা হয়েছিল সকলেই তা জানে। তবে?
দেখুন নিয়তির কি অলঙঘ্য আদেশ! নিয়তি কি নির্মম!
উইল করবার পর শ্রীকণ্ঠ যখন তাঁর স্ত্রীর কাছে সেই কথা একদিন বলেছিলেন, সেই সময় হঠাৎ রসময় সেই ঘরে গিয়ে প্রবেশ করেন এবং সব কথা তিনি জানতে পারেন।
একথাটা রসময় তাঁর মৃত্যুর কিছুক্ষণ পূর্বেই সখেদের সঙ্গে নাকি তার স্ত্রী মালতী দেবীকে বলেছিলেন।
মালতী দেবীই পরে সেকথা আমাকে বলেন। এই ব্যাপারের আগে পর্যন্ত মালতী দেবীও শ্রীকণ্ঠের দ্বিতীয় উইল সম্পর্কের বিন্দুবিসর্গও জানতেন না। আগেই বলেছি হত্যার বিষ রায়বংশের রক্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সেই বিষের নেশাতেই রসময় শ্রীকণ্ঠ মল্লিককে হত্যা করেন এবং সুবিনয় আবার তার পিতা রসময়কে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন। কারণ শ্রীকন্ঠের দ্বিতীয় উইলের কথা তিনি শুনেছিলেন। যদিও সুবিনয়ের সেই উইলটির অস্তিত্ব সম্পর্কে তাঁর কোন জ্ঞানই ছিল না। তাঁর হয়ত ভয় হয়েছিল, তাঁর পিতা না আবার বিমাতার প্ররোচনায় নতুন করে কখনও কোন দুর্বল মুহূর্তে কোন এক উইল করেন। পিতা রসময়ের চাইতে পুত্র সুবিনয় আর এক ধাপ উঠে যান। শ্রীকণ্ঠকে হত্যা করবার পর রসময় সুরেন চৌধুরীকেও ইহসংসার থেকে সরাতে মনস্থ করেন। আপদের শেষ না রাখাই ভাল, হয়ত এই নীতিই তাঁর ছিল। চিরদিনের মত সরিয়ে ফেলবার জন্যই সাদরে চাকুরি দিয়ে রসময় সুরেনকে নৃসিংহগ্রামে দেওয়ানজীর পদে এনে নিযুক্ত করলেন। এক ঢিলে দুই পাখীই মারা হল। এবং এবারেও শিবনারায়ণকেই সুরেনকে হত্যা করবার জন্য নিযুক্ত করলেন। শিবনারায়ণ হয়ত এবারে দেখলে, বার বার এইভাবে টাকার লোভে হত্যা করবার মধ্যে প্রচুর বিপদের সম্ভবনা আছে, তাই সে এবারে রসময়ের উপরেও এক হাত নিল।
সুরেনকে হত্যা না করে তাঁকে গুম করে ফেললে এবং শ্রীকণ্ঠকে হত্যা করবার সময় যে কর্মচারীটি তার দক্ষিণ হস্তস্বরূপ ছিল, তাকেই হত্যা করে হত্যার পর চেহারার বিকৃতি ঘটিয়ে সুরেনের মৃতদেহ বলে চালিয়ে দিল। এবং সুরেনের মৃত্যু (?) রটনার সঙ্গে সঙ্গে শিবনারায়ণ আবির্ভূত হল রঙ্গমঞ্চে এবারে। এতদিন ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে, এবারে প্রকাশ্যে রসময়ের সাহায্যে নৃসিংহগ্রামে নায়েবীর গদীতে উপবেশন করে তার আসল খেলা শুরু করল।
শিবনারায়ণ সুরেনকে একেবারে হত্যা না করে কেন গুম করে রাখলো তা নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি।
শিবনারায়ণের সঙ্গে যদি কোনদিন দেখা করতে পারতাম তবে এই ব্যাপারের একটা খোলাখুলি আললাচনা করতে পারতাম, কিন্তু ঘটনাচক্রে তা তো হয়ে উঠল না, তাই বর্তমানে হত্যা-রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে যে explanationটা মনে মনে আমি দাঁড় করিয়েছিসেটাই এবার আলোচনা করব। ইচ্ছা হলে আপনি সেটা গ্রহণ করতে পারেন, না হলে ভুলেও যেতে পারেন, কারণ বর্তমান মূল ঘটনার মীমাংসার ব্যাপারে উক্ত ঘটনাটা একেবারে বাদ দিলেও হতভাগ্য সুধীন চৌধুরীর মুক্তির কোন বাধা থাকবে বলে আমার মনে হয় না।
আমার মনে হয় শিবনারায়ণের কাছে অর্থটাই ছিল সব চাইতে বড় জিনিস, তার পূর্ববর্তী জীবনকে পর্যালোচনা করলেও সেই কথাটা বেশী করে এক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলেই মনে হবে।
শিবনারায়ণ লোকটা ছিল যেমন প্রচণ্ড নৃশংস, তেমনি ভয়ঙ্কর অর্থপিশাচ, অথচ সুবিনয়ের চাইতে ঢের বেশী বুদ্ধি রাখত সে।
রসময়ের সহকারীরূপে সে শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিককে হত্যা করতে এতটুকু দ্বিধা করেনি, এবং নিজেকে বাঁচাবার জন্যই সে নিজহাতে শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিককে হত্যা না করে অন্যের দ্বারা হত্যা করিয়েছিল। তারপর রসময় যখন সুরেনকে আবার হত্যা করবার জন্য মনস্থ করলে, তখনও সে রসময়কে সাহায্য করতে দ্বিধাবোধ করেনি বিন্দুমাত্রও। শিবনারায়ণ ইতিমধ্যে সুবিনয়ের সঙ্গেও বেশ জমিয়ে নিয়েছিল। সে দেখলে রসময়ের দিন ফুরিয়ে এসেছে, ভবিষ্যতে গদীতে বসবে সুবিনয় মল্লিক, সুবিনয়কে হাতে রাখতে পারলে ভবিষ্যতে সুবিনয়কেও অনায়াসেই দোহন করা চলতে পারে। তাই হয়ত সে সুরেনকে প্রাণে একেবারে না মেরে গুম করে ফেলবার মনস্থ করলে, অবিশ্যি আগেই বলে নিয়েছি এটা আমার একটা অনুমান মাত্র।
সুরেন চৌধুরীকে হত্যার অভিনয় করে এক ঢিলে চতুর-চুড়োমণি শিবনারায়ণ দুই পাখি মারল। এখানে একটা কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক, গুপ্তকক্ষের সংবাদ শিবনারায়ণ কেমন করে পেল? এক্ষেত্রেও আমার মনে হয়, প্রথমে হয়ত সে সুরেনকে অন্য কোথাও লোকচক্ষুর অন্তরালে বন্দী করে রেখেছিল, পরে নৃসিংহগ্রামে নায়েবী পদে অধিষ্ঠিত হয়ে গুপ্তকক্ষের সন্ধান পায় কোন উপায়ে এবং সেখানে সুরেনকে বন্দী করে রাখে।
শিবনারায়ণ শ্রীকণ্ঠকে নিজহাতে হত্যা না করলেও, হত্যায় সাহায্য সে করেছিল, হত্যার সাহায্যকারী হিসাবে সে অপরাধী এবং murder or abattement of murder বস্তুত অপরাধটা একই শ্রেণীর। দণ্ড মুকব হয় না। শ্ৰীকণ্ঠর হত্যার ব্যাপারে রসময়ই একমাত্র সাক্ষী বেঁচে তখনও, প্রধান সাক্ষীকে তো আগেই সে শেষ করে ফেলেছিল। যা হোক নির্বিঘ্নে রসময়কে পৃথিবী হতে সরানো হল বিষপ্রয়োগে। হতভাগ্য সুবিনয় নিজের অজান্তেই শিবনারায়ণের মুঠোর মধ্যে এসে ধরা দিলেন।