লক্ষ্য করেছিলাম, রাণীমা ঘরে প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গেই সুহাসিনী দেবী মুখটা ফিরিয়ে নিলেন। সুহাসিনী দেবীর মনের মধ্যে তখনও আলোড়ন চলছে।
মা, এদিকে ফিরে তাকান। মুখ ফিরিয়ে থাকলে চলবে না। এঁকে আপনি চেনেন কিনা জানি না, হয়তো চেনেন, ইনিই মৃত সুহাসের জননী, রায়পুরের রাণীমা মালতী দেবী। ভাগ্যবিড়ম্বনায় আজ এঁরই একমাত্র পুত্রহন্তারূপে আপনার একমাত্র পুত্র যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে দণ্ডিত। অথচ যাদের কেন্দ্র করে এত বড় নির্মম ঘটনাটা গড়ে উঠল, তাদের সৌহার্দ্য ও প্রীতি অতুলনীয়। তাদের মধ্যে একজন আজ মৃত। সেইজন্যই আমার আজ অনুরোধ, আপনারা পরস্পর পরস্পরের দোষ-ত্রুটি ভুলে গিয়ে আপনাদের পুত্রের পরস্পরের ভালবাসার স্মৃতিকে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখুন।
ইনি কে কিরীটীবাবু? মালতী দেবী সুরেন্দ্র চৌধুরীকে নির্দেশ করে প্রশ্ন করলেন।
এঁর পরিচয় আপনাকে দেওয়া হয়নি রাণীমা, ইনি ডাঃ সুধীন চৌধুরীর পিতা সুরেন্দ্র চৌধুরী।
সে কি! তবে যে শুনেছিলাম—
হ্যাঁ, লোকে এতকাল তাই জানত বটে। ইনি আজও জীবিতই আছেন। এঁকে নৃসিংহগ্রামের পাতালঘরে গুম করে রাখা হয়েছিল।
মালতী দেবীর দু চোখের কোণ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু নেমে এল।
আর আমার কোন দুঃখ রইল না কিরীটীবাবু। গরীব বাপের অনেকগুলো সন্তানের মধ্যে আমি একজন। রূপ ছিল বলেই রাজবাড়িতে আমি স্থান পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম দুঃখের বুঝি আমার অবসান হল। কিন্তু বিধাতা যার কপালে সুখ লেখেননি, তাকে সুখী কেউ করতে পারে না। আমাদের দেশে একটা প্রবাদ আছে কিরীটীবাবু, বেটে দিলেও চটে যায়—আমার কপালেও ঠিক তাই হল। সুখের চন্দনপ্রলেপ আমার কপাল থেকে শুকিয়ে ঝরে পড়ে গেল। কিন্তু সে কথা থাক। আমার সুহাস যে নিজের জীবন দিয়ে তার পিতা-প্রপিতামহের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে গেল এবং সমস্ত অন্যায়ের মীমাংসা এমনি করে দিয়ে গেল, আজকের আমার এতবড় দুঃখেও সেইটাই সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা হয়ে রইল। বলতে বলতে সুহাস-জননী এগিয়ে এসে সুহাসিনীর হাত দুটি চেপে ধরলেন, সত্যিই এতদিনে আমার মুক্তি মিলল দিদি। তোমার স্বামীকে তুমি ফিরে পেয়েছ। তোমার ছেলেও তোমার বুকে ফিরে আসুক। আমার উপরে এবং আমার মৃত স্বামীর উপরে আর কোন ক্ষোভ রেখো না। বল রায়পুরের রাজগোষ্ঠীর সকল অপরাধই তুমি ক্ষমা করলে!
নীরবে সুহাস-জননী মালতী দেবীকে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন।
তাঁর কণ্ঠে ভাষা ছিল না। শুধু চোখে ছিল নীরব অশ্রু। বুকের সমস্ত অকথিত ভাষাই আজ অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে লাগল।
এরপর মালতী দেবী আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কিরীটীবাবু, রাত্রি অনেক হল, আমাকে আপনি কেন ডেকেছিলেন, তা তো কই বললেন না?
এইজন্যই আপনাকে ডেকেছিলাম রাণীমা।
তাহলে এবারে আমি যাই!
মালতী দেবী ঘরে হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন, রাণীর মতই মাথা উঁচু করে, মর্যাদার গৌরবে।
২.১৬ বিশ্লেষণ
জাস্টিস মৈত্র আবার কিরীটীর চিঠিতে মন দিলেন, একপাশে কিরীটীর ডাইরীর অনুলিপিগুলো সরিয়ে রেখে
কিরীটী লিখেছে :
আবার ফিরে যাওয়া যাক রায়পুর-রহস্যের মধ্যে। মালতী দেবী নিজেই বলেছেন, জানতে পারলেন গরীবের ঘরে তাঁর জন্ম। তবু রূপ ছিল বলে রাজবাড়িতে বিয়ে হল তাঁর। কিন্তু ভাগ্যদেবতা পরিহাস করলেন তাঁর সঙ্গে—রাণীর মুকুট তাঁর মাথায় পরিয়ে দিলেন বটে কিন্তু সে মুকুট ছিল দুঃখের কণ্টকে কণ্টকিত। তবু বলব বোধ হয় মালতী রাণীর একটা সহজাত গরিমা নিয়েই জন্মেছিলেন। ভেবে দেখুন শেষ পর্যন্ত তাঁর সেই আভিজাত্যবোধই তাঁকে দিয়ে সব কিছু স্বীকার করাল এবং মালতী দেবী যদি নিজ হতে আমার সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করে না ধরতেন, তবে হয়ত রায়পুরের রহস্য এত শীঘ্র উদঘাটন করা আমার পক্ষেও সম্ভব হত না। তাঁকে আমি কোনদিনই ভুলতে পারব না। সেরাত্রে আমার বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার পর আর তিনি রাজবাড়িতে ফিরে যাননি। কোথায় গেছেন কেউ তা জানে না। তবে যতদূর মনে হয় তিনি কোন তীর্থস্থানেই জীবনের বাকি কটা দিন কাটাতে চলে গেছেন হয়ত। তাঁর জীবনের শেষের দিন কটি শান্তিতে কাটুক, এই প্রার্থনাই জানাই সেই সর্বনিয়ন্তার কাছে। তাঁকে আমার প্রণাম জানিয়ে আরও একবার রহস্য বিশ্লেষণে ফিরে যাই।
আগেই বলেছি শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে যখন নৃসিংহগ্রামে যান, তাঁর ছেলে রসময়ও সেইসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাপ ও ছেলেতে বনিবনা আদপেই ছিল না কোনদিন। তার কারণও হয়ত রসময়ের শরীরে যে অতি সাধারণ রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল তার দুষ্ট প্রভাব। এবং রসময় যে মুহূর্তে শুনলেন শ্রীকণ্ঠ নতুন উইল করেছেন, তিনি হয়ত ভেবেছিলেন তাঁর তখন পিতা শ্রীকণ্ঠকে হত্যা করা ছাড়া হয়ত আর দ্বিতীয় কোন পথ নেই। তাই শিবনারায়ণের সঙ্গে গোপনে চক্রান্ত করে শ্রীকণ্ঠ মল্লিককে হত্যা করা হল।
এবং নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, সম্পত্তির লোভেই রসময় তাঁর দত্তক পিতা শ্রীকণ্ঠ মল্লিককে হত্যা করতে কুণ্ঠিত হননি। সত্যিকারের পিতা ও পুত্রের মধ্যে রক্তের যোগাযোগে যে স্বাভাবিক স্নেহ ও ভালবাসা গড়ে ওঠে তার কিছুই তো ছিল না রসময় ও শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের মধ্যে, এবং সেটা না থাকাটাই স্বাভাবিক। অবশেষে সম্পত্তি পাবার পর এবং ঐ সুবিপুল সম্পত্তি তাঁর হাতের মুঠোর মধ্যেও এসে পাছে আবার নাগালের বাইরে চলে যায় এই ভয়েই হয়ত তাঁকে শেষ মুহূর্তে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে ফেলেছিল। রসময় যদি নিজ হাতে তাঁর পিতাকে হত্যা করতেন দুষ্কর্মের কোন সাক্ষী না রেখে, তবে হয়ত বর্তমান হত্যা-মামলা অন্যপথে প্রবাহিত হত; কিন্তু তা হল না। অত বড় গহিত ও দুষ্কর্ম একাকী সাঙ্গ করবার মত মনোবল রসময়ের হয়ত ছিল না বলেই তাঁর দুষ্কর্মের সঙ্গী হিসাবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন শিবনারায়ণকে। এবং এসব ক্ষেত্রে যা হয়, শিবনারায়ণই অবশেষে ভূত হয়ে রসময়ের কাঁধে চেপে বসল, রক্ত চোষার মতই শিবনারায়ণ রসময়ের রক্ত চুষে নিতে লাগল দিনের পর দিন। এবং স্বভাবতই ক্রমশ রসময় রক্তহীন হয়ে পড়তে লাগলেন।