কূটচক্রী শিবনারায়ণ জগন্নাথকে অমনি আকস্মিকভাবে পাতালঘরে আবির্ভূত হতে দেখে কি ভেবেছিল তা সে-ই জানে, তবে সুব্রতর জবানীতে সেই মুহূর্তে শিবনারায়ণের কথা শুনে এইটেই মনে হয় যে, ব্যাপারটা শিবনারায়ণেরও ধারণার অতীত ছিল।
ধূর্ত শিবনারায়ণ সহসা ঐ মুহূর্তে জগন্নাথকে দেখে হয়ত ভেবেছিল, জগন্নাথ সুবিনয়েরই নিযুক্ত চর। এবং ঐ সময়কার শিবনারায়ণের কথাবার্তা শুনে মনে হয়, জগন্নাথের আসল পরিচয়ও যেমন সে জানত না, তেমনি জগন্নাথের ঐভাবে ঐ ঘরের মধ্যে আবির্ভাবের উদ্দেশ্যটাও বুঝে উঠতে পারেনি। চোরের মন বোঁচকার দিকেই থাকে সর্বদা, এতে আশ্চর্য হবার তেমন কিছুই নেই। ব্ল্যাকমেল করে দীর্ঘকাল ধরে শিবনারায়ণও যে সুবিনয়ের কাছ হতে কত টাকা নিয়েছে কে বলতে পারে! এতদিন সে নিশ্চিন্তই ছিল, কিন্তু হঠাৎ জগন্নাথকে দেখে মনে হয়েছিল হয়ত তার দিন ফুরিয়েছে।
জগন্নাথ ঠিক কেন ঐরাত্রে পাতালঘরে গিয়ে প্রবেশ করে তা সঠিকভাবে বোঝ না গেলেও, একটা মীমাংসায় হয়তো অনায়াসেই আমরা আসতে পারি। সেটা হচ্ছে এই, জগন্নাথ নিশ্চয়ই জানত না সুব্রত পাতালঘরের সন্ধান পেয়েছে ইতিপূর্বে এবং সেখানে সুরেন চৌধুরীর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছে। এবং এও হয়ত সে-কারণেই জানত না, ঠিক ঐ রাত্রে ঐ সময় শিবনারায়ণ ও সুব্রত পাতালঘরেই আছে। আমার ধারণা অবিশ্যি ভুলও হতে পারে, জগন্নাথ ঐ রাত্রে দুঃখীরামের সাহায্যে পাতালঘরে প্রবেশ করেছিল, সবার অলক্ষ্যে সুরেন চৌধুরীকে পাতালঘর থেকে সরিয়ে অন্যত্র কোথাও নিয়ে যাবার জন্য। এবং একবার সুরেন চৌধুরীকে সরিয়ে নিজের মুঠোর মধ্যে আনতে পারলে, তারপর সে নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের প্ল্যান-মাফিক কাজ করতে পারবে।
আমার ধারণা, এই বিচিত্র হত্যা-নাটকের চতুর্থ অঙ্কই হচ্ছে শ্রীমান জগন্নাথের প্ল্যান বা পরিকল্পনা। আপনি হয়ত জানেন, আমরা অনেক সময় আমাদের সৎপ্রণোদিত কাজের মধ্য দিয়েও অন্যের সর্বনাশ ডেকে আনি। এক্ষেত্রে রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিকও তাই করেছিলেন। পূর্বপুরুষের, বিশেষ করে জন্মদাতা পিতার অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য তিনি পরবর্তী জীবনে যে শেষ উইলটি করেছিলেন, যার ফলে এতগুলো নির্মম হত্যা একটার পর একটা হয়ে গেল, সেই উইলই হল কাল।
রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিক যদি হত্যার কিছুদিন পূর্বে দ্বিতীয় উইলটি না করতেন, হারাধনের পৌত্র জগন্নাথকে এভাবে রায়পুরের মাকড়সার জালের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হত না। আমার অনুমান মাত্র, কারণ জগন্নাথ আর ইহজগতে নেই। নির্মম নিয়তির অমোঘ বিধানে সে তার দুর্নিবার লোভের উপযুক্ত মাশুলই কড়ায়-গণ্ডায় বোধ হয় শোধ করে গেছে। নাহলে একবার ভেবে দেখুন, কী তার অভাব ছিল! তার পিতামহ হারাধন মল্লিক যা রেখে যেতেন মৃত্যুর পর, জগন্নাথের বাকি জীবনটা সুখে-স্বচ্ছন্দেই কেটে যেত। কোনো আর্থিক অভাবই তার হত না কোনোদিন। তাছাড়া তার ভাগ্যে যদি রায়পুরের সম্পত্তি-লাভ থাকতই, তবে মৃত্যুর পূর্বে রত্নেশ্বর ওভাবে তাঁর পুত্রদের বঞ্চিত করে যাবেনই বা কেন? যে ধনে তার সহজ দাবি ছিল, সে ধন হতে কেন সে বঞ্চিত হবে? তাই মনে হয়, এ বিধাতার অভিশাপ ছাড়া আর কি! তাই সন্তুষ্ট সে হতে পারল না এবং মরীচিকার পশ্চাতে ছুটে গেল। পিতামহের স্নেহের নীড় থেকে ছুটে গেল আলোকশিখালোভী পতঙ্গের মত; হতভাগ্য ছুটে গেল কোথায়–না নৃসিংহগ্রামের পাতালঘরে! ভেবে দেখুন লোভের কি নির্মম প্রায়শ্চিত্ত! কী করুণ মৃত্যু!
অভিশপ্ত এই রায়পুর স্টেট ও তার বিশাল ধনসম্ভার। রাজা রত্নেশ্বর, রাজা রসময়, রাজা শ্রীকণ্ঠ, সুহাস মল্লিক, নিশানাথ মল্লিক, সতীনাথ লাহিড়ী, জগন্নাথ মল্লিক একের পর এক নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছেন এবং শিবনারায়ণ আজ বদ্ধ উন্মাদ। রাজা সুবিনয়। ধর্মাধিকরণের বিচারের অপেক্ষায়। সত্যি এ ধরনের জটিল ও নৃশংস হত্যার মামলায় ইতিপূর্বে আমি হাত দিইনি জাস্টিস মৈত্র!
জগন্নাথ পরিকল্পনা করেছিল হয়ত সুরেন চৌধুরীকে পাতালঘর থেকে উদ্ধার করে নিজের কাছে রেখে কৌশলে ভীতিপ্রদর্শন করে একই সঙ্গে রাজা সুবিনয় মল্লিক ও শিবনারায়ণের নিকট থেকে অর্থশোষণ করবে। একেবারে সাদা কথায় যাকে বলে black-mailing! এবং হয়তো অর্থশোষণ করাই তার ইচ্ছা ছিল, কেননা জগন্নাথ জানত সুবিনয়ের নিকট থেকে সম্পত্তির ভাগ পাওয়া সুদূরপরাহত। যে নিজের ভাইকেও, যাকে শিশুকাল হতে দেখে আসছে, ঐ সম্পত্তির জন্য অকাতরে খুন করতে পারে–আর যাই সে দিক সম্পত্তির ভাগ নিশ্চয়ই দেবে না! জগন্নাথের প্রয়োজন যখন অর্থের, তখন যে উপায়েই থোক অর্থ পেলেই হল— তা সে সম্পত্তি-প্রাপ্তির মধ্য দিয়েই হোক বা অন্য কোন পথে অর্থপ্রাপ্তির মধ্য দিয়েই হোক।
এখন কথা হচ্ছে, জগন্নাথের হঠাৎকেন সন্দেহ হয় যে সুরেনচৌধুরী আজও মরেননি—বেঁচে আছেন এবং হয়ত নৃসিংহগ্রামের পুরাতন প্রাসাদেই কোথাও-না-কোথায়ও আছেন। আমার ধারণা জগন্নাথ কোনক্রমে ব্যাপারটা নৃসিংহগ্রামের কাছারীর শিবনারায়ণের ভৃত্য দুঃখীরামকে টাকা খাইয়ে তাকে হাত করেই জেনেছিল। এবং যখন সে-কথা সে জানতে পারল, তখন তার মত বুদ্ধিমান ছেলে সহজেই অনুমান করতে পেরেছে, কেন শিবনারায়ণ সুরেন চৌধুরীকে গুম করে রেখেছে ঐ নৃসিংহগ্রামের প্রাসাদের কোন এক গুপ্তকক্ষে। আরও বিশদভাবে ব্যাপারটা আপনাকে বুঝতে হলে এবার তাহলে কিছুক্ষণের জন্য আবার আমাকে নাটকের তৃতীয় অঙ্কে ফিরে যেতে হয়।
২.১৫ কিরীটীর ডাইরী
সুব্রতর ইচ্ছা, এখানে আমার ডাইরীর কয়েকটা পৃষ্ঠা পড়ে দেখুন, তাই সে আমার ডাইরী। থেকে খুব যত্ন সহকারে নকল করে দিয়েছে।