তাহলে এবারে আমাদের নাটকের চতুর্থ অঙ্কে আসা যাক। আগেই বলেছি, এই চিঠির মধ্যে নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে, নিলোভ হারাধনের পৌত্র জগন্নাথ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। যে রক্ত পিতামহ সুধাকণ্ঠের শরীরে ছিল, সেই রক্তই প্রবাহিত হচ্ছে জগন্নাথের শরীরের প্রতি শিরা ও ধমনীতে। এবং জগন্নাথ সেই দৃষিত রক্তের ডাকেই সাড়া দিয়েছে। হয়তো বলবেন, হারাধন ও জগন্নাথের পিতার শরীরেও তো সেই রক্তধারাই প্রবাহিত হচ্ছিল, কিন্তু তাঁর তো রক্তের ডাকে সাড়া দেননি! এবং তাঁদেরই ছেলে জগন্নাথ তবে কেন এ পথে এল? তার জবাবে আমি বলব, অনেক বংশে, কেউ পাগল থাকলে, পরবর্তী পুরুষে অনেক সময় সেই পাগলামি আবার ফিরে যেমন আসে এবং হয়ত মাঝখানে দু-একটা পুরুষ বাদ। যায়—এর বেলাতেও হয়ত তাই হয়েছে। জেনেটিকস-এ তাই বলে। যা হোক, যে লোভ হারাধন বা তাঁর ছেলেকে বিচলিত করতে পারিনি, সেই লোভের আগুনেই জগন্নাথ তার হাত দুটি পোড়াল। জগন্নাথকে প্রথম আমি কবে কেমন করে সন্দেহ করি, জানেন? রায়পুরে গিয়ে হারাধনের ওখানে যখন দুদিন কাটাই সেই সময়ে। লেখাপড়ায় জগন্নাথ ছেলেটি অত্যন্ত চৌকশ। হারাধনের মুখেই একদিন শুনেছিলাম, ছোটবেলা থেকেই একবার পড়বার বই পেলে জগন্নাথ আর কিছুই চাইত না। সেই জগন্নাথ হঠাৎ এম. এ. পড়তে পড়তে পড়াশুনা একদম ছেড়ে দিয়ে তার দাদুর অসুখের অজুহাত নিয়ে রায়পুরে এসে বসল। আর একটা জিনিস, জগন্নাথের সঙ্গে রায়পুরের স্টেট সংক্রান্ত কোনো কথাবার্তা বললেই বোঝা যায়, কি প্রচণ্ড একটা ঘৃণা সে পোষণ করে রায়পুর স্টেট ও তৎসংক্রান্ত লোকদের ওপরে।
জগন্নাথ শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণ যুবক। মানুষের মনে যে ঘৃণার উদ্রেক হয় তা অনেক কারণে হয়, তার মধ্যে অন্যতম দুটি কারণ হচ্ছে, প্রথমত কোন কারণবশত হয়ত আপনাকে আমার একেবারেই পছন্দ নয়, আপনি নীচ ও জঘন্য প্রকৃতির, আমার সমকক্ষ একেবারেই নন—আপনার প্রতি সহজেই আমার একটা ঘৃণা জন্মাবে। দ্বিতীয়ত আমি আপনার সমকক্ষ নই, আমার সকল প্রকার ধরা-ছোঁয়া ও নাগালের বাইরে আপনি, অথচ সর্বদা আমি অনুভব করছি, আমাদের পরস্পরের মধ্যে যে বৈষম্য, সেটা নিছক ভাগ্যদোষে হয়েছে। আপনি আমার চাইতে কোনো অংশে শ্রেষ্ঠ নন—তথাপি আপনার নাগাল পাবার আমার উপায় নেই। এবং এই যে ব্যর্থতা সর্বদা আমায় পীড়ন করছে, এই ব্যর্থতা হতেই ক্রমে আপনার প্রতি আমার একটা ঘৃণার ভাব আসতে পারে এবং তখন কেবল এই কথাটাই আমি ভাবব, আমাদের পরস্পরের মধ্যে যদি কোনো পার্থক্যই হওয়া উচিত নয়, তথাপি আপনি আমার নাগালের বাইরে। এ অবিচার, এ অন্যায়। এই ধরনের ঘৃণা হতে অনেক সময় মানুষ ঘৃণার ব্যক্তিকে খুন পর্যন্ত করতেও পশ্চাৎপদ হয় না। জগন্নাথের অন্তরে এই দ্বিতীয়োক্ত ঘৃণাই প্রবল হয়ে উঠেছিল রায়পুরের রাজবাটীর সকলের বিরুদ্ধে।
হারাধনের মুখেই আমি শুনেছি, বর্তমানে হারাধনের যা সঙ্গতি আছে, তাতে সহজভাবে জগন্নাথের জীবন চলে যেতে পারে। কিন্তু জগন্নাথের মনে ছিল আরও উচ্চাশা। আমি আরও জানতে পেরেছি, ভাগ্যক্রমে নয়ই বরং বলা চলতে পারে একান্ত দুভাগ্যক্রমে, মৃত ছোট কুমার সুহাসের সঙ্গে একই কলেজে একই শ্রেণীতে জগন্নাথ পড়ত। লেখাপড়ায় সুহাসের চাইতে জগন্নাথ অনেক শ্রেষ্ঠ ছিল। অথচ সুহাসের পক্ষে যে প্রাচুর্যতা সম্ভবপর ছিল, জগন্নাথের পক্ষে সেটা ছিল দুঃসাধ্য। কারণ হারাধনের এত পয়সা নেই যে জগন্নাথকে সুহাসের মত সমানভাবে মানুষ করেন। সুহাসের বিলাত যাওয়ার সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু জগন্নাথ হারাধনের কাছে সে প্রস্তাব করায়, হারাধন স্পষ্টই তার অসামর্থ্যের কথা জানিয়ে দেন। কোনো একদিন গল্পের ছলে হারাধন জগন্নাথকে শ্ৰীকণ্ঠের উইলের কথা বলেছিলেন। সেই গল্প শোনার পর হতেই হয়ত জগন্নাথের অবচেতন মনে একটা প্রবল ঘৃণা জন্ম নেয়। এবং হয়ত মনে হয়েছে, তার সৌভাগ্যক্রমে আজ যে বস্তুটা পেয়ে সুহাস ভাগ্যবান, দুর্ভাগ্যক্রমে তা হতে বঞ্চিত হয়ে জগন্নাথ নিজে ব্যর্থ ও ভাগ্যহীন। এবং ক্রমে যত দিন যেতে থাকে, নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সেটা জগন্নাথের মনে আরো প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। সেই অবিশ্রাম ঘৃণার ছিদ্রপথেই জগন্নাথের দেহে শনি প্রবেশ করে। যে অর্থে সম্ভাবনা তার হাতে এসেও ফসকে গেছে দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই অর্থকে করায়ত্ত করবার জন্য সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। গোপনে সে নৃসিংহগ্রামে গিয়ে সেইখানকার পুরাতন ভৃত্য দুঃখীরামকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে হাত করে।
সুরেন চৌধুরী যে নৃসিংহগ্রামের কাছারী-বাড়ির গুপ্তকক্ষে শিবনারায়ণের হাতে বন্দী হয়ে আছে সে সংবাদ দুঃখীরাম অর্থের বিনিময়ে জগন্নাথকে সরবরাহ করে। ধূর্ত জগন্নাথ তখন আর এক চাল চালে। সুবিনয় মল্লিককে সেই সংবাদ দিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেল করতে মনস্থ করে। এবং তার পূর্বে সেই সংবাদের সত্য-মিথ্যা যাচাই করবার জন্যই জগন্নাথ নৃসিংহগ্রামে গিয়ে হাজির হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমার নির্দেশমত সুব্রত তখন নৃসিংহগ্রামে উপস্থিত এবং সেও তখন সুরেনের অস্তিত্ব গুপ্তকক্ষে টের পেয়েছে।
জগন্নাথকে গুপ্তকক্ষের দরজার সামনে ছেড়ে দিয়ে দুঃখীরাম বিদায় নেয়। সুব্রত গুপ্তকক্ষে উপস্থিত। জগন্নাথকে নৃসিংহগ্রামে কাছারী-বাড়ির গুপ্তকক্ষে দেখে সুব্রত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ঠিক সেই সময়ে শিবনারায়ণও সেই কক্ষে গিয়ে প্রবেশ করল। ভেবে দেখুন নাটকের কত বড় ক্লাইমেক্স!