মালতী দেবীর চিঠিতেও বুঝতে পেরেছেন এবং আমিও বলছি, সতীনাথ লাহিড়ীকেও মৃত্যুবাণ বুক পেতে নিতে হয়েছে এইজন্য যে সতীনাথ ছিল সুবিনয়ের সকল দুষ্কর্মের সাথী। তার হাতে অনেক প্রমাণই ছিল—এদের মিলিত পাপানুষ্ঠানের। সতীনাথের বেঁচে থাকাটা তাই আর সম্ভবপর হল না।
কিন্তু সে-সব কথা যাক, আসুন আবার আমরা অতীতের ভুলে-যাওয়া-ঘটনার মধ্যে ফিরে যাই। আমরা জানি শ্রীকণ্ঠ মল্লিক নৃসিংহগ্রামের কাছারীবাড়িতে অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নৃসংশভাবে নিহত হয়েছিলেন!
কে সেই অদৃশ্য আততায়ী? আর কেনই বা তিনি এমন নিষ্ঠুরভাবে নিহত হলেন? রাজা যজ্ঞেশ্বরের হত্যাকারী তাঁরই পুত্র রত্নেশ্বর। এবং রত্নেশ্বরকে বিষপ্রয়োগে হত্যার প্রচেষ্টা করেন তাঁরই মধ্যম ও কনিষ্ঠ পুত্র সুধাকণ্ঠ ও বাণীকণ্ঠ মল্লিক। অবিশ্যি এটা আমার অনুমান মাত্র। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস দেখুন, রসময় যে মুহূর্তে আর পিতার কাছ থেকে ঝগড়ার সময় শুনল, তার বাপের নতুন উইল অনুযায়ী তিনি রায়পুরের একচ্ছত্র অধীশ্বর হতে পারবেন না, একটি অংশের মাত্র অধিকারী, তখুনি তিনি আর কালবিলম্ব না করে বাপকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলেন। হয়ত কিছু আগে পরে ঐসময়েই অর্থের লোভে দাগী আসামী পলাতক শিবনারায়ণ রসময়ের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছিল। সুহাসের হত্যা-মামলা যখন আপনার কোটে চলতে থাকে তখনই সাক্ষীর কাঠগড়ায় একদিন শিবনারায়ণকে দেখে আমার মনে হয়েছিল তার মুখটা যেন কেমন চেনা-চেনা লাগছে। আমার যেন কেমন একটা দোষ আছে, বিশেষ কোন ব্যক্তির বিশেষ কোন মুখ একবার দেখলেই মনের ক্যামেরার লেন্স দিয়ে সেটা আমি ধরে রাখি মনের মধ্যে। শিবনারায়ণের ছবিও মনের মধ্যে আমার ঠিক তেমনই গেঁথে গিয়েছিল। লালবাজারে ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অ্যালবামে খুঁজলে শিবনারায়ণের ছবিও দেখতে পাবেন, আমি সেটা ইতিমধ্যে মিলিয়ে নিয়েছি। তার আসল নাম পণ্ডিত চৌধুরী। বহুকাল আগে নোট জালের সাধু (?) প্রচেষ্টার মোকদ্দমায় সে একবার বিশ্রীভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে কোনমতে সেই মামলা থেকে রেহাই পেয়ে সুবিনয় মল্লিককে কেমন করে যে তর করল বলতে পারব না, তবে অনুমান করছি হয়ত সুবিনয় মল্লিকই তাঁর যোগ্য সহচরটিকে খুঁজে নিয়েছিলেন বা শিবনারায়ণ নিয়েছিল খুঁজে। আরও একটা কথা—একবার তার সঙ্গে আমার প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছিল, কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাকে বাঁধতে পারিনি সেবার। সে গল্প আর একদিন আপনাকে বলব।
আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে,আমি আগাগোড়াই বলে আসছি, রায়পুরের এই বিরাট হত্যার ব্যাপারে মূলে আছে—অর্থম অনর্থম! সুবিনয় মল্লিককে আপনি সাজা দিতে পারবেন কিনা জানি না, তবে এই বিরাট হত্যাযজ্ঞের অন্যতম প্রধান হোতা হচ্ছেন তিনিই—প্রথমে তাঁর পিতা রসময়কে হত্যা করানো শিবনারায়ণের সাহায্যে এবং তারপরে ডাঃ সুধীন চৌধুরীর পিতা সুরেন চৌধুরীকে হত্যা করবার চেষ্টা।
কিন্তু কথায় বলে না, শয়তানেরও বাপ আছে! শিবনারায়ণ সুবিনয়ের উপর আর এক চাল চাললে। সুরেন চৌধুরীকে হত্যা না করে তাকে নৃসিংহগ্রামের পুরাতন প্রাসাদের এক গুপ্তকক্ষে গুম করে রাখে। এবং তার বদলে তৃতীয় একজন ব্যক্তিকে, যে শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের হত্যার সময় শিবনারায়ণকে সাহায্য করেছিল, তাকে হত্যা করে এক ঢিলে দুই পাখি মারল।
হত্যা করার পর মৃতদেহটি এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল যে তাকে আর চেনবার কোনও উপায় ছিল না। এমন কি দেহ হতে মস্তকটিকে একেবারে প্রায় দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়ায় কেউ চিনতেই পারেনি আসলে নিহত ব্যক্তি সুরেন চৌধুরীই কিনা। অবিশ্যি তৎসত্ত্বেও একমাত্র যিনি চিনতে পারতেন তিনি সুধীনের মা, সুহাসিনী দেবী। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুসংবাদে তখনকার তাঁর মনের অবস্থা এমন ছিল যে, সে সময় সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখবার মত কোন ক্ষমতাই তাঁর তখন থাকতে পারে না। তিনি মৃতদেহ দেখেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান এবং জ্ঞান হবার পূর্বেই মৃতদেহ সরিয়ে ফেলা হয়। লোক জানল সুরেন চৌধুরীই নিহত হয়েছেন।
কিন্তু এখন কথা হচ্ছে, কেন শিবনারায়ণ সুরেন চৌধুরীকে হত্যা না করে গুম করে রেখেছিল দীর্ঘকাল ধরে! কিসের আশায়? আগেই বলেছি শিবনারায়ণ কী চরিত্রের লোক। দুটি কারণে শিবনারায়ণ সুধীন চৌধুরীকে গুম করে রেখেছিল হত্যা না করে। প্রথমত সত্যিই যদি কোনোদিন কোনো কারণে তার কীর্তিকলাপ অন্যের চক্ষে ধরা পড়েও, সে অনায়াসেই গুপ্তকক্ষ থেকে সুরেনকে এনে সাফাই গাইতে পারবে। এবং দ্বিতীয়ত সুরেন চৌধুরী তার হাতে থাকলে, সেই সঙ্গে সুবিনয় মল্লিকও তার হাতের মুঠোর মধ্যে থাকে এবং সহজেই ইচ্ছামত সুবিনয়কে দোহন করতে পারা যাবে। কখনো দোহন করতে করতে যদি সুবিনয় কোনোদিন কোনো কারণে বেঁকে বসেন, তাহলে সে-মুহূর্তে শিবনারায়ণ অনায়াসেই তার গুপ্ত বাণ (সুরেন চৌধুরী যে আসলে নিহত হয়নি) সুবিনয়ের প্রতি প্রয়োগ করতে পারবে। ক্রিমিন্যালদের সাইকোলজি বড় অদ্ভুত, না! এখন কথা হচ্ছে, এই গোপন ব্যাপার আর কেউ জানত কিনা? হ্যাঁ জানত, একজন জানত। সে আমাদের হারাধনের পৌত্র জগন্নাথ মল্লিক। চমকে উঠছেন, না? সত্যি চমকাবারই কথা।