সে তার কথা রেখেছে। হাতে আমার কোন প্রমাণ নেই বটে, তবে আমি জানি সুহাসের হত্যা-ষড়যন্ত্রের মধ্যে সুবিনয় এবং কালীপদ মুখার্জী, ডাঃ অমিয় সোম, তারিণী চক্রবর্তী সবাই লিপ্ত আছে। আপনি হয়ত ভাবছেন, এসব কথা এতদিন জানা সত্ত্বেও কোর্টে যখন মামলা চলছিল, সেই সময় সব কথা প্রকাশ করে দিই নি কেন? তার কারণ, আমি দেখেছিলাম সুহাস তো আর ফিরে আসবেই না এবং সুবিনয়ও যদি যায়, আমার স্বামীর শেষের অনুরোধতাও রক্ষা হয় না। তাছাড়া মৃত্যু দিয়ে মৃত্যুর শোধ তোলা যায় না। একজন তো গেছেই, আর একজনকেই বা কেন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিই! সেও তো আমার স্বামীরই সন্তান। আমার বুকের দুধ সে পান না করলেও, অকাতরেই তাকে আমি আমার মায়ের স্নেহ দিতে কার্পণ্য করিনি কোনদিন। আমার চোখে সুহাস ও তার মধ্যে কোন পার্থক্যই তো ছিল না। সে আমাকে মা বলে না স্বীকার করলেও, তাকে আমি সন্তান বলেই জানি। সে যে সুহাসের সঙ্গে একই বুকের তলায় বড় হয়ে উঠেছে।
সুধীনের প্রতি যে অন্যায় হচ্ছিল, প্রতি মুহূর্তেই তা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমি যদি সব স্বীকার করতাম, তাহলে সুবিনয়ের ফাঁসী হত সুনিশ্চিত। তাতে করে আমার মৃত স্বামীর মুখে ও তাদের এত বড় বংশে চুনকালি পড়ত। এই বংশের দিকে চেয়ে লোকে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিত। শেষ পর্যন্ত আমার মৃত স্বামীর কথা ভেবেই আমি চুপ করে রইলাম। মুখ খুললাম না। সুধীনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের কথা শুনে অবধি নিরন্তর আমি অনুশোচনায় ও বিবেকের দংশনে দগ্ধ হচ্ছিলাম, তারপর ঠাকুরপো (নিশানাথ)-কেও যখন সুবিনয় হত্যা : করলে এবং তারই তদন্তে এসে আপনি আর একজন অভাগিনী জননীর মর্মদাহের কথা আমায় শোনালেন, আর স্থির থাকতে পারলাম না।
সুহাসের মৃত্যুর পর অনেক দিন আগেকার একটা ঘটনা আমার মনে পড়েছিল, সুহাসের তখন বছর ছয়েক বয়স, সুবিনয়ের বয়স বছর চোদ্দ হবে, ধনুর্বাণ খেলার ছলে খেলার তীরের সঙ্গে কুঁচফলের বিষ মাখিয়ে সুবিনয় সুহাসকে মারবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একটা গরুর গায়ে বেঁধে এবং সেই বিষে গরুটা মরে। গরুটার মৃত্যুর পর, সেই তীর পরীক্ষা করে পশুর ডাক্তার সেই কথা বলেছিল— কিন্তু তীরের ফলায় কোথা হতে যে কুঁচফলের বিষ এসেছিল, সেকথা সেদিন আমরা কেউ তলিয়ে ভেবে দেখিনি। তাহলেই ভেবে দেখুন সেই ছোটবেলা হতেই সুবিনয়ের সুহাসের প্রতি একটা জাতক্রোধ ছিল। অথচ শুনে আশ্চর্য হবেন, সুহাস দাদা বলতে যেন অজ্ঞান ছিল। দাদাকে সে দেবতার মতই ভক্তিশ্রদ্ধা করত। আমার চাইতেও বোধ করি সে তার দাদাকে বেশী ভালবাসত। আপনি আমাকে সে রাত্রে একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মনে আছে নিশ্চয়ই আপনার, চিৎকার শুনে আমি ঠাকুরপোর ঘরে ছুটে গিয়ে তাকে জীবিত দেখেছিলাম?ি হ্যাঁ,সেদিন আমি স্বীকার করিনি, আজ করছি অকুষ্ঠে, ঠাকুরপো তখনও বেঁচে ছিলেন এবং মরবার সময় তিনি শেষ কথা বলে যান, সুবিনয়—বিনু সে-ই আমায় শেষটায় মারলে!…এমন সময় সুবিনয় সেই ঘরে এসে প্রবেশ করে হন্তদন্ত হয়ে।
আমি ঠিক রান্নাঘর থেকে ঠাকুরপোর চিৎকার শুনিনি, তাঁর ঘরে ঢুকছিলাম, এমন সময় শুনি। আমার মনে হয় সতীনাথকে সুবিনয়ই মেরেছে,কিন্তু কেমন করে তা জানি না। আমার ধারণা মাত্র। হয়ত নাও হতে পারে। সতীনাথের মৃত্যুতে আমি এতটুকুও দুঃখিত নই, বরং খুশীই হয়েছি। এই বংশের ঐ শনি। সুবিনয়ের ঐ ছিল ডান হাত, তবে ইদানীং দেখতাম, দুজনের মধ্যে তত সম্প্রীতি ছিল না, প্রায়ই কথা-কাটাকাটি হত। আমার যতটুকু জানাবার ছিল সবটাই আপনাকে জানালাম। এতদিন পরে আমার স্বীকারোক্তি দিয়ে ভাল করলাম কি মন্দ করলাম জানি না। সুধীনকে ছাড়িয়ে আনতে যদি পারেন তবেই হয়ত এপাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হবে। অহর্নিশি এই বিষযন্ত্রণা হতে মুক্তি পাব। আমার নমস্কার জানবেন।
ইতি
মালতী দেবী
২.১৪ কিরীটীর চিঠি
মালতী দেবীরপত্রখানা পড়ে শেষ করে জাস্টিসমৈত্র আবার কিরীটীর পত্রটি পড়তে লাগলেন।
মালতী দেবীর চিঠিখানা আগাগোড়া পড়লে এ হত্যা-মামলার অনেক কিছুই দিনের আলোর মত আপনার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। বেচারী মালতী দেবী! এখন বোধহয় বুঝতে পারছেন, ডাঃ সুধীনের ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সের মোটা অঙ্কটা কোথা হতে সংগৃহীত হয়েছিল এবং কেনই বা সে ইচ্ছাকৃত অস্বীকৃতি দিয়ে নিজেকে বিপদগ্রস্ত করেছিল? ধনুর্বাণ খেলার ছলে সুবিনয় যখন সুহাসকে মারবার চেষ্টা করেন তীরের সঙ্গে বিষ মিশ্রিত করে, নিশানাথ সে-সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাই তিনি পাগলামির ঝোঁকে বলতেন—That child of the past! Again he started his old game! সতীনাথের হত্যার দিন আরও তিনি বলেছিলেন একটা কথা, পাগলের প্রলাপোক্তি বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল, একটি দশ-এগারো বছরের কিশোর বালক—but the seed of the villainy was already in his heart! ধনুর্বাণ খেলার ছলে খেলার তীরের সঙ্গে কুঁচফলের বিষ মাখিয়ে তারই একজন খেলার সাথীকে মারতে গিয়েছিল, কিন্তু সব উল্টে গেল—বিষ মাখানোতীরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একটা গরুকে মেরে ফেললে। মালতী দেবীর চিঠি হতেও প্রমাণিত হয়, সেই কিশোর বালকটি কে। আর কেউ নয়—ঐ সুবিনয় মল্লিক। পাছে কথাটা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাই সুবিনয়ের বিচারে নিশানাথের পৃথিবী হতে অপসারণের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তীরে এসে তরী ডোবানো যায় না, নিশানাথকে তাই মৃত্যুবাণ বুক পেতে নিতে হল। নির্মম ভাগ্যচক্র!