প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, শোনা যায় রসময়েরও নাকি আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। একদিন আহারাদির পর হঠাৎ তিনি অসুস্থ বোধ করেন, ডাক্তার-বদ্যি এল, কিন্তু কোন ফল হল না, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই তিনি মারা (?)গেলেন। এবারে সুবিনয় মল্লিক হলেন রায়পুরের রাজাবাহাদুর। কিন্তু রসময় উইল করে গিয়েছিলেন, সমগ্র সম্পত্তি সমান দুভাগে সুবিনয় ও সুহাসে বর্তাবে। পিতা রসময়ের মৃত্যুর পরই সুবিনয় স্টেটের কিছু অদলবদল করলেন।
নতুন খাজাঞ্চী এল তারিণী চক্রবর্তী ও তার কিছুকাল পরে স্টেটের ম্যানেজার হয়ে এলেন অধুনা মৃত সতীনাথ লাহিড়ী। এইভাবে তৃতীয় অঙ্ক শুরু হল। সুবিনয় চেষ্টা করছিলেন, কি ভাবে সুহাসকে চিরদিনের মত তাঁর পথ থেকে সরিয়ে সমস্ত সম্পত্তি একা ভোগ করবেন। ষড়যন্ত্র শুরু হল। সুবিনয়ের পরামর্শ ছাড়াও সহায় হলেন ডাক্তার কালীপদ মুখার্জী, খাজাঞ্চী তারিণী চক্রবর্তী, ম্যানেজার সতীনাথ লাহিড়ী ও নৃসিংহগ্রামের নায়েব শিবনারায়ণ চৌধুরী। এবারে রাণীমা মালতী দেবী আমাকে যে পত্রটি দিয়েছিলেন, যা মামলার অন্যতম evidence হিসাবে আপনাকে পাঠালাম, সেটা পড়ুন। তারপর আবার আমার চিঠি পড়বেন।
২.১৩ রাণীমার স্বীকৃতি
রায়পুর
ইনসপেক্টারবাবু,
আপনি হয়ত অবাক হবেন কে আপনাকে এই চিঠি লিখছে, তাই প্রথমেই পরিচয়টা দিয়ে নিই, আমি রায়পুরের ছোট কুমার হতভাগ্য সুহাসের জননী মালতী। আপনি সে-রাত্রে চলে যাওয়ার পর আমি অনেক ভেবেছি, শেষটায় সব আপনাকে জানানোই মনস্থ করে এই পত্র আপনাকে লিখতে বসেছি। সুহাস আজ মৃত। কোনদিনই আর সে এ অভাগিনীকে মা বলে ডাকবে না। সুহাসের অকালমৃত্যুতে সংসার আমার কাছে একেবারে শূন্য হয়ে গেছে। আর বেঁচে থেকেই বা লাভ কি! আপনি ঠিকই বলেছিলেন, একজন নির্দোষ যদি আমারই জন্য শাস্তি পায়, ভগবানের বিচারে আমি রেহাই পাব না। আপনি কে এবং আপনার সত্য পরিচয় যে কি তা আমি জানি না। তবে আপনার সঙ্গে সে-রাত্রে কথাবার্তা বলে এইটুকুই বুঝেছি, আপনি যেই হোন, আপনার কাছে কিছু চাপা থাকবে না। সবই একদিন আপনি বুঝতে পারবেন। যাগে ওসব কথা, যা বলতে আজ কলম ধরেছি তাই বলি—সুবিনয়। ও সুহাস আমার কাছে পৃথক নয়। তাছাড়া আমার স্বামীও জানতেন সুবিনয় আমার পেটে না হলেও, সুহাসের চাইতে তাকে আমি কম ভালবাসি না। বরং সুহাসের চাইতে তাকে আমি বেশীই স্নেহ করতাম চিরদিন, এবং হয়ত—হয়ত এখনও করি। বুঝতে পারেন কি, সেই এতখানি স্নেহের প্রতিদানে সুবিনয়ই যখন সুহাসের প্রাণ নেবার ষড়যন্ত্র করছিল, কত বড় আঘাত আমি পেয়েছিলাম। আমি প্রথম সে-কথা টের পাই সুহাসের মৃত্যুর মাস ছয়েক পূর্বে। ঘটনাটা তাহলে খুলেই বলি। সুহাসের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে, তার চোখের গোলমাল হওয়াতে চক্ষু-চিকিৎসকের নির্দেশমত তাকে চশমা নিতে হয়। চশমাটা যেদিন সতীনাথ কলকাতা থেকে তৈরী করে নিয়ে এল, আমার সঙ্গে বসে বসে সুহাস গল্প করছিল। ওর দাদা এনে চশমাটা ওর হাতে দিল। চশমাটা ছিল রিমলেস। চোখে দেবার পর দেখা গেল চশমাটা একটু ঢিলে হচ্ছে। সুবিনয় পাশেই দাঁড়িয়ে তখন। চশমাটা ঠিক বসছে না দেখে ও বলে, কিছু না, ঠিক করে দিচ্ছি। বলতে বলতে এগিয়ে এসে সুহাসের নারে উপরে বসানো চশমাটা বেশ জোরে টিপে দিল, সুহাসের নাকের দুপাশ টিপুনির চোটে কেটে গেছিল, সে উঃ করে ওঠে! সেইদিনই দ্বিপ্রহরের দিকে সুহাস অসুস্থ হয়ে পড়ে। ক্রমে জানা যায় সুহাসের টিটেনাস হয়েছে। রায়পুরে ভাল অ্যান্টিটিটেনাস সিরাম পাওয়া যাবে না বলে সতীনাথ কলকাতায় যায় এবং প্রত্যহ সেখান হতে সিরাম অ্যামপুল পাঠাতে থাকে। শুনলে আশ্চর্য হবেন, সেই অ্যামপুলগুলোর কোনটারই মধ্যে সিরাম থাকত না, থাকত স্রেফ জল। ফলে অসুখের কোন উন্নতিই হয় না। তখন আমি সুধীনকে সব কথা লিখে জানাই গোপনে এবং সুধীনই এখানে এসে সুহাসকে একপ্রকার জোর করে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তার চিকিৎসার সুব্যবস্থা করে তাকে সুস্থ করে তোলে। সুহাসের সেবার টিটেনাস হওয়ায় সুধীন নিজে ও অন্যান্য ডাক্তাররা বেশ একটু আশ্চর্যই হয়েছিল। শরীরের কোথাও কোন ক্ষতচিহ্ন নেই, কেমন করে টিটেনাস রোগ হল! হায়, তখন কি জানি যে চশবার যে দুটো প্লেটের মত অংশ নাকের ওপরে চেপে বসে, তাতে টিটেনাস ব্যাসিলি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে জানতে পারি সুহাসের শরীরে প্লেগের বীজ ইনজেক্ট করার জন্যই সুহাস অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভাবছেন নিশ্চয়ই সে কথাটা কি করে জানলাম, না? সুহাসের মৃত্যুর আগে এবারে অসুখের সময় হঠাৎ একদিন সুবিনয় ও কালীপদ মুখার্জীর মধ্যে যখন আলোচনা চলছিল গোপনে, তখন তাদের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে গিয়ে কয়েকটা কথা আমার কানে আসে। সুবিনয় ডাঃ মুখার্জীকে বলছিল, মরিয়া না মরে অরি! সেবার চশমার প্লেটে টিটেনাস বীজ মাখিয়ে দিলেন, কত চেষ্টা হল, সব ভেস্তে গেল! তার জবাবে ডাঃ মুখার্জী বলেন, এবারে আর বাছাধনকে বাঁচতে হবে না, এবারে একেবারে মোক্ষম মৃত্যুবাণ ছেড়েছি। আমার টাকাটার কথা ভুলবেন না কিন্তু রাজাবাহাদুর! তাদের কথা শুনে শরীর যেন আমার পাথরের মত জমে গেল। কানের মধ্যে তখন আমার ভোঁ ভোঁ করছে। ভাবতে পারেন আমার তখন কি অবস্থা! যার হাতে নিশ্চিত বিশ্বাসে তুলে দিয়েছি আমার একমাত্র পুত্রের জীবনমরণের সমস্ত ভার, সে-ই কিনা চিকিৎসকের ছদ্মবেশে বিষপ্রয়োগ করেছে! সেইদিনই আমি একপ্রকার জোর করেই কলকাতা যাবার ব্যবস্থা করলাম এবং সুধীনকে গোপনে আমাদের কলকাতার বাসায় সেইদিনই দেখা করবার জন্য তার করে দিলাম। আমরা কলকাতায় যেদিন পৌঁছই সেইদিনই বিকেলের দিকে সুধীন আমাদের বাসায় আসে। তাকে ডেকে গোপনে সব কথা খুলে বলি। পরদিন আমি আর সুধীন অন্য ডাক্তার আনার কথা বলি। প্রথমে সুবিনয় একেবারেই রাজী হয় না, তখন আমি ও সুধীন একপ্রকার জেদাজেদি করে ডাঃ সেনগুপ্তকে ডেকে আনাই। তার পরের ঘটনা তো সবই আপনারা জানেন। ব্লাড-কালচারের রিপোর্ট পৌঁছবার আগেই আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। আরও একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন মনে করি। প্রথমবার সুহাসকে টিটেনাস রোগ থেকে ভাল করবার পর, সুহাসের অনুরোধেই আমি সুধীনকে দশ হাজার টাকা ধার হিসাবে দিয়েছিলাম, তার ওষুধ সাপ্লাইয়ের ব্যবসার জন্য। কিন্তু সুধীন সে টাকা নিল বটে, তবে কারবারে আমাকে অংশীদার করে নেয়। আজ বলতে লজ্জা নেই, আমার স্বামীর মৃত্যুর পর স্টেটের একটি পয়সার ওপরেও আমার কোন অধিকার ছিল না। সুহাস যখন আমার কাছে এসে সুধীনকে টাকা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়, আমি চারদিকে অন্ধকার দেখি। আমি জানতাম, কেঁদে ভাসিয়ে দিলেও সুবিনয় দশ হাজার তত দূরে থাক, একটি কপর্দকও দেবে না আমাকে। আমি তখন একপ্রকার নিরুপায় হয়েই শেষটায় সুবিনয়ের ঘরে ঢুকে, তার আয়রন সেফ খুলে ঐ দশ হাজার টাকা চুরি করে সুহাসকে দিই সুধীনকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য, সুবিনয় কথাটা জেনে ফেলে। শেষটায় আমার সুহাস ও সুবিনয়ের মধ্যে একটা লিখিত চুক্তি হয়, ওই দশ হাজার টাকা সুহাসের ভাগ থেকে কাটা যাবে। এবং তাহলেই সুবিনয় এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করবে না। যদি মামলার সময় সুধীনের ব্যাঙ্কের মজুত টাকার কথা ওঠে, তখন পাছে সমস্ত কথাই আদালতে প্রকাশ পায়, আমার চুরির কথা লোকে জানতে পারে, সেই ভয়ে আমি একদিন গোপনে কারাগারে সুধীনের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ জানাই এ-কথা কাউকে না বলতে। সুধীন আমাকে বাঁচাতে গিয়েই সব দোষ মাথা পেতে নেয়, একটি কথাও ও-সম্পর্কে আদালতে প্রকাশ করেনি। সেদিন সে আমায় বলেছিল, মামীমা, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, সুহাসের মা আপনি—ফাঁসী যেতে হয় যাব তবু কাউকে এ-কথা বলব না। আপনাকে আদালতে টেনে আনব না। এ কথা আগে বলে আপনি ভালই করলেন, নচেৎ এসব কথা তো আমার জানা ছিল না।