চোখের দৃষ্টি বুঝি অন্ধ হয়ে যাবে।
শিবনারায়ণ হাসছে, পাগলের মতই হাসছে অন্ধকারে, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে সেই উচ্চহাসির শব্দ যেন ঝন্ ঝন্ করে করতালি দিয়ে দিয়ে ফিরছে দেওয়ালে দেওয়ালে।
আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল।
ঘর হতে বেরুতে হবে। অন্ধকারে শিবনারায়ণ হাতড়ে হাতড়ে পাতালঘর থেকে বাইরে বের হবার রাস্তা খুঁজতে শুরু করে এবারে।
এ কি, অন্ধকারে কি শিবনারায়ণ পথ হারিয়ে ফেলল!
অন্ধকারের গোলকধাঁধা।
শিবনারায়ণ পাগলের মতই ঘোরে ঘরের ভিতর।
কিন্তু না, পথ কই! আলল—একটু আলো!
পাগলের মতই শিবনারায়ণ অন্ধকারের মধ্যে চিৎকার করে ওঠে, কে আছ, বাঁচাও, ওগো কে আছ, বাঁচাও!
না, এই তো দরজা! কিন্তু এ কি! এ যে বাইরে থেকে বন্ধ!
উন্মাদের মত শিবনারায়ণ বন্ধ দরজার উপরে কিল চড় লাথি বসাতে থাকে।
শক্ত সেগুন কাঠের দরজা।
কি হবে! তবে কি তাকে এই অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে তিল তিল করে মরতে হবে!
মৃত্যু! কে শুনতে পাবে তার চিৎকার!
সুরেন! সুরেন! কোথায় তুমি! আমাকে বাঁচাও ভাই!
ছাব্বিশ বছর এই পাতালঘরে তোমাকে আমি বন্দী করে রেখেছি। দিনের পর দিন রাতের পর রাত তোমার বুকভাঙা কান্না শুনেছি। এখন বুঝতে পারছি কি যন্ত্রণা তুমি এই ছাব্বিশ বছর ধরে পলে পলে সহ্য করেছ! ক্ষমা কর ভাই, আমাকে ক্ষমা কর আমাকে বেরুতে দাওযা চাও তুমি তাই দেব— সুরেন, সুরেন—
কিন্তু কেউ সাড়া দিল না।
শিবনারায়ণ একবার কাঁদে একবার হাসে।
একটা অস্পষ্ট খস্ আওয়াজ না! যুবকের মৃতদেহ কি আবার প্রাণ পেল! সুরেন! সুরেন! বেঁচে আছ কি?.. কথা বল! সাড়া দাও! অনেক টাকা তোমাকে দেব আমি। রাজা করে দেব—ও কে…রাজা শ্রীক মল্লিক!
ঘুরছে–শিবনারায়ণ পাগলের মতই অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে ঘুরছে! হঠাৎ একসময় যুবকের হীমশিতল মৃতদেহের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
কে? কে?
যুবকের ঠাণ্ডা অসাড় দেহটার ওপর শিবনারায়ণ হাত বুলায়।
সুরেন! আমার অনেক টাকা! রাজাবাহাদুর আমাকে অনেক টাকা দিয়েছে! সিন্দুকভর্তি টাকা আমার! এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট—একশ হাজার দশ বিশ পঁচিশ!
***
দিন দুই বাদে বিকাশ দলবল নিয়ে সুব্রতর নির্দেশমত যখন পাতালঘরে প্রবেশ করল শিবনারায়ণ তখনও টাকার অঙ্ক গুনে চলেছে। মৃতদেহটা ফুলে পচে উঠেছে, একটা উৎকট দুর্গন্ধে ঘরের বদ্ধ বাতাস যেন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।
২.১২ কিরীটীর বিশ্লেষণ
জাস্টিস মৈত্র অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, সেদিন সকালবেলা যখন কিরীটীর ভৃত্য জংলী এসে একটা ছাতা, একটা পুলিন্দা ও দশ-বারো পৃষ্ঠাব্যাপী একটা খামে-আঁটা চিঠি তাঁর হাতে দিল।
এসব কি?
আজ্ঞে বাবু পাঠিয়ে দিলেন।
তোর বাবু কোথায়?
আজ্ঞে তিনি ও সুব্রতবাবু গতকাল সন্ধ্যার গাড়িতে পুরী বেড়াতে গেছেন।
কবে ফিরবেন?
দিন পনের বাদে বোধ হয়।
জংলী চলে গেলে জাস্টিস্ মৈত্র প্রথমেই পুলিন্দাটা খুলে ফেললেন। তার মধ্যে দুখানা চিঠি, একটি পাঁচ সেলের টর্চবাতি, কতকগুলো ক্যাশমেমো, ইনভয়েস দুটি, সতীনাথ লাহিড়ীর একটি হিসাবের খাতা। একজোড়া লোহার নাল-বসানো দারোয়ানী প্যাটার্নের নাগরাই জুতো।
জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে এক পাশে সরিয়ে রেখে জাস্টিস মৈত্র কিরীটীর চিঠিটায় মনসংযোগ করলেন।
প্রিয় জাস্টিস্ মৈত্র,
আপনি আমার রহস্য-উদঘাটনের কাহিনীগুলো শুনতে খুব ভালোবাসেন জানি চিরদিন। তাই আজ আপনাকে একটা চমৎকার কাহিনী শোনাব। এবং আমার কাহিনী শেষ হলে, তার সব কিছু ভাল-মন্দ বিচারের ভার আপনার ওপরেই তুলে দিতে চাই, কারণ ধর্মাধিকরণের আসনে আপনি বসে আছেন, আপনিই যোগ্যতম ব্যক্তি। নিরপেক্ষ বিচার আপনার কাছেই পাব। ভাগ্যবিড়ম্বনায় ও দশচক্রে একজন নির্দোষ ব্যক্তি কারাগারে বন্দী হয়ে আছেন, তাঁর প্রতি সুবিচার করবেন। পুলিসের কর্তৃপক্ষ এ কাহিনীর বিন্দুবিসর্গও জানে না; একটিমাত্র পুলিসের লোক ছাড়া, কিন্তু সেও আমার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আপনার নির্দেশ ব্যতীত সে কোনো কিছুই করবে না। আপনাদের বিচারে প্রমাণিত হয়েছে, রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের হত্যাপরাধী ডাঃ সুধীন চৌধুরী। এবং তার শাস্তিভোগ করছে সে আজ কারাগারের লৌহশৃঙ্খল পরে। এতটুকুও সে প্রতিবাদ জানায়নি। আপনি আজও জানেন না—একজনকে বাঁচাতে গিয়ে, সমস্ত অপরাধের গ্লানি সে নীরবে মাথা পেতে নিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে।
গোড়া থেকে শুরু না করলে হয়ত আপনি বুঝতে পারবেন না। তাই এই কাহিনী আমি গোড়া হতেই শুরু করব।
এদেরই, মানে রায়পুর রাজবংশের পূর্বপুরুষ রাজা রত্নেশ্বর মল্লিক, তাঁর তিন পুত্র, জ্যেষ্ঠ শ্রীকণ্ঠ মল্লিক, মধ্যম সুধাকণ্ঠ ও কনিষ্ঠ বাণীকণ্ঠ মল্লিক। শ্রীকণ্ঠ সুধাকণ্ঠের চেয়ে ন বৎসরের বড়, আর সুধাকণ্ঠের চেয়ে বাণীকণ্ঠ সাত বৎসরের ছোট। রত্নেশ্বরের একমাত্র মেয়ে কাত্যায়নী দেবী। কাত্যায়নীর একমাত্র ছেলে সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী, সুরেন চৌধুরীর স্ত্রী হচ্ছেন সুহাসিনী দেবী, তাঁরই একমাত্র ছেলে ডাঃ সুধীন চৌধুরী যে সুহাসের হত্যাপরাধে অপরাধী, বর্তমানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদে কারারুদ্ধ। রাজা রত্নেশ্বরের পিতা যজ্ঞেশ্বর মল্লিক মশাই ছিলেন সেকালের একজন অত্যন্ত দুর্ধর্ষ জমিদার। নৃসিংহগ্রামের কোনো একটি প্রজাকে যজ্ঞেশ্বর একদা স্টেট-সংক্রান্ত কোনো একটি মামলায় মিথ্যা সাক্ষী দিতে বলেন, কিন্তু প্রজাটি রাজী না হওয়ায় তাকে যজ্ঞেশ্বর হত্যা করেন। যজ্ঞেশ্বরের নায়েব ছিলেন শ্রীদীনতারণ মজুমদার মহাশয়। দীনতারণ যজ্ঞেশ্বরকে দেবতার মত ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন, হত্যাপরাধে সমস্ত দোষ স্বীয় স্কন্ধে নিয়ে দীনতারণ হাসিমুখে ফাঁসীর দড়িতে গলা বাড়িয়ে দিলেন। এবং মৃত্যুর পূর্বে তাঁর মাতৃহারা একমাত্র সন্তান শ্রীনিবাস মজুমদারকে যজ্ঞেশ্বরের হাতে দিয়ে যান। যজ্ঞেশ্বর নিজের সন্তানের মতই শ্রীনিবাসকে মানুষ করে পরবর্তীকালে স্টেটে নায়েবীতে বহাল করেন। যজ্ঞেশ্বরের পুত্র রত্নেশ্বর কিন্তু শ্রীনিবাসকে সুচক্ষে দেখতে পারেননি কোনোদিনই। শ্রীনিবাসের প্রতি একটা প্রচণ্ড হিংসা তাঁকে সর্বদা পীড়ন করত। যজ্ঞেশ্বর এ কথা জানতে পেরে মৃত্যুর পূর্বে একটা উইল করে রায়পুর স্টেটের সর্বাপেক্ষা লাভবান জমিদারী নৃসিংহগ্রামের অর্ধেক অংশ মুজমদার বংশকে লিখে দিয়ে যান। যজ্ঞেশ্বরের মৃত্যুর পর রত্নেশ্বর পিতার ঋণ সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন এবং নামমাত্র মূল্যে কৌশল করে আবার তিনি নৃসিংহগ্রামটি সম্পূর্ণরূপে নিজের ভোগদখলে নিয়ে এলেন। এমন কথাও শোনা যায় যে, রত্নেশ্বর নাকি বিষপ্রয়োগে পিতা যজ্ঞেশ্বরকে হত্যা করেন। সত্য-মিথ্যা জানি না।