থাকোহরি বারান্দাতেই বসেছিল। সুব্রতকে দেখে সানন্দে উঠে দাঁড়ায়।
সুব্রত বললে, চটপট করে আমাদের স্নানের জল দে বাথরুমে থাকোহরি। আর বেশ কড়া করে দুপেয়ালা চা তৈরী করে আন দেখি!
থাকোহরি ফ্যালফ্যাল করে তার মনিবের সঙ্গে যে লোকটা এসেছে, অত বেশভূষা দাড়িগোঁফ ও একমাথা রুক্ষ চুল,তার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। এ লোকটা কোথা থেকে এল আবার? কাকে আবার সঙ্গে করে বাবু নিয়ে এলেন? কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও সাহস পেলে না।
ঠাণ্ডাজলে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে শরীরটা যেন জুড়িয়ে গেল।
লোকটাকে দাড়িগোঁফ কামিয়ে ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরিয়ে দেবার পর তার চেহারা একেবারে পাল্টে গেল। লোকটা সুব্রতকে কোনো বাধা দিল না। থাকোহরিকে দিয়ে সুব্রত থানায় কিরীটীর কাছে একটা সংবাদ পাঠিয়ে দিল। রাত্রি প্রায় দশটার সময় কিরীটী ও বিকাশ এসে হাজির হল। লোকটা তখন সুব্রতর ঘরে শুয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সুব্রত ধীরে ধীরে নৃসিংহগ্রামের সমগ্র ঘটনা একটুও না বাদ দিয়ে ওদের কাছে বলে গেল।
সমস্ত শুনে কিরীটী বললে, কাল সকালেই আমি ওকে নিয়ে কলকাতায় চলে যাব। বিকেলের দিকে প্রায় ছটা নাগাদ একটা ট্রেন আছে, তাতেই তুই কলকাতায় চলে যাবি। এখানকার কাজ আমাদের শেষ হয়েছে। রায়পুর রহস্যের ওপরে এবারে আমরা যবনিকাপাত করব।
এই লোকটা কে, কিরীটীবাবু? বিকাশ প্রশ্ন করে।
আমার মনে হচ্ছে খুব সম্ভবত সুরেন চৌধুরী—ডাঃ সুধীন চৌধুরীর বাপ। কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দেয়।
সে কি! তাহলে উনি যে অনেকদিন আগে মারা গিয়েছিলেন বলে আমরা জানি, সেটা তবে সত্যি কথা নয়?
না। যদিও আসল খুনী, মানে যে সুরেন চৌধুরীকে এ পৃথিবী থেকে সরাতে চেয়েছিল, সে জানত সুরেন চৌধুরীকে হত্যা করাই হয়েছে, কিন্তু মাঝখান থেকে বোধ হয় আর একটি অদৃশ্য হাত সব ওলটপালট করে দেয়।
তাহলে যে সুরেন চৌধুরীকে হত্যা করতে চেয়েছিল, সে আজও জানে না উনি বেঁচে আছেন?
খুব সম্ভবত না।
২.১১ পাতালঘরে
মিনিটে মিনিটে ঘণ্টা কেটে গেল।
প্রথমে জ্ঞান ফিরে আসে যুবকের। ধুলো বালি রক্তে বীভৎস চেহারা। প্রদীপের আলোয় আবছা আবছা অন্ধকারে পাতালঘরটা থমথম করছে।
প্রদীপের সামান্য তেল ফুরিয়ে এল। আর বেশীক্ষণ জ্বলবে না, এখুনি নিভে যাবে। নিশ্চিদ্র অন্ধকারে ঘরটা ড়ুবে যাবে।
মাথার মধ্যে এখনও ঝিম্ ঝিম্ করছে। স্মৃতিশক্তি ধোঁয়ার মত অস্পষ্ট। যুবক একবার উঠে বসবার চেষ্টা করে, কিন্তু শক্তিতে কুলোয় না। এলিয়ে পড়ে।
শিবনারায়ণের জ্ঞান ফিরে এল। অস্পষ্টযন্ত্রণাকাতর একটা শব্দ করে শিবনারায়ণও নড়েচড়ে ওঠেন।
আরও আধ ঘণ্টা পরে।
প্রদীপের আলো প্রায় নিভুনিভু তখন, ঘরের মধ্যে যেন একটা ভৌতিক আলোছায়ার লুকোচুরি খেলা।
যুবকের কোমরে যে তীক্ষ্ণ ছোরাটা গোঁজা ছিল সেটা সে টেনে বের করে।
রক্তাক্ত মুখের ওপরে মাথার চুলগুলো এসে পড়েছে।
চোখেমুখে একটা দানবীয় জিঘাংসা।
শিবনারায়ণ!
অস্পষ্ট প্রদীপের আলোয় যুবকের হস্তধৃত ধারাল ছোরাটা যেন মৃত্যুক্ষুধায় হিলহিল করছে। ঐদিকে দৃষ্টি পড়ায় শিবনারায়ণ যেন বারেক শিউরে ওঠে; চোখেমুখে একটা আতঙ্ক সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
শিবনারায়ণ!
তুমি কি আমায় খুন করতে চাও?
যদি বলি তাই?
কিন্তু কেন? কেন তুমি আমায় খুন করবে?
খুন তোমাকে আমায় করতেই হবে। যুবক এগিয়ে আসে।
শিবনারায়ণ এক পা দু পা করে দেওয়ালের দিকে পিছিয়ে যায়।
কোথায় পালাবে আজ তুমি শিবনারায়ণ! এই অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে কতটুকু জায়গা তুমি পাবে পালাবার? তোমাকে খুন করব। হ্যাঁ, খুন করব। এই তীক্ষ্ণ ছোরাটার সবটুকুই তোমার বুকে বসিয়ে দেব। ফিকি দিয়ে তাজা লাল রক্ত বের হয়ে আসবে। প্রাণভয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় তুমি চিৎকার করে উঠবে। কেউ সে চিৎকার শুনতে পাবে না। কেউ জানতে পারবে না। দীর্ঘকাল ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে যেমন সুরেন চৌধুরী বন্দী হয়ে ছিল, কেউ জানতে পারে নি, তেমনি তোমার মৃতদেহও এই ধূলিমলিন অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে পড়ে থাকবে।
কেন— কেন তুমি আমাকে অমন নৃশংসভাবে হত্যা করবে? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি?
মরতে যেন তুমি ভয় পাচ্ছ মনে হচ্ছে শিবনারায়ণ?
ভয়! না, ঠিক তা না।
তবে? ভয় কি শিবনারায়ণ, শুধু যে তোমাকেই মরতে হচ্ছে তা নয়, মরতে আমাকেও হবে। তবে দুদিন আগে আর পরে এই হ্যাঁ। তাছাড়া ভেবে দেখ, ফাঁসীর দড়িতে ঝুলে অসহনীয় শ্বাসকষ্ট পেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর চাইতে তোমার এ মৃত্যু ঢের ভাল, নয় কি?
ঐ সময় যুবকের সামান্য অসতর্কতায় শিবনারায়ণ যুবকের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, শয়তান!
অতর্কিত আক্রমণে যুবক মেঝের উপর পড়ে যায়।
অসীম শক্তি শিবনারায়ণের দেহে শিবনারায়ণ যুবকের উপর চেপে বসে দুহাতে প্রাণপণ শক্তিতে যুবকের গলাটা চেপে ধরে। জোরে, আরও জোরে চাপ দেয়। যুবকের চোখ দুটো কি এক অস্বাভাবিক আতঙ্কে যেন অক্ষিকোটর হতে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়।
গোঁ গোঁ একটা অস্পষ্ট শব্দ যুবকের গলা দিয়ে বের হয়ে আসে। ক্রমে যুবকের দেহটা শিথিল হয়ে আসে। জোরে আরও জোরে শিবনারায়ণ যুবকের গলায় দশ আঙুলের চাপ দেয়।
তারপরই শিবনারায়ণ পাগলের মত হেসে ওঠেন।
প্রদীপটা শেষবারের মত দপ্ করে একবার জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল। অন্ধকার! নিচ্ছিদ্র অন্ধকার!