এ তো পাগলের প্রলাপোক্তি নয়। এ যেন কোন মর্মপীড়িতের বুকভাঙা কান্না। মর্মান্তিক কার যেন এ বিলাপধ্বনি!
আবার বলতে থাকে, চিনলে না তো আমায়—চিনলে না তো! চিনবেই বা কেমন করে? ছাব্বিশ বছর আগে যে মরে গেছে, তাকে কি আজ আর চেনা যায়! না তাকে কেউ চিনতে পারে! তারপরই হঠাৎ কেমন যেন ভয়চকিত কণ্ঠে বলে ওঠে, পালাও, এখুনি পালাও। সে দেখলে আর তোমার রক্ষা থাকবে না। সে বড় নিষ্ঠুর, আমাকে কথা পর্যন্ত বলতে দেয় না—কথা বললেই একটা সরু চামড়ার চাবুক আছে, তাই দিয়ে সপাং সপাং করে আমায় মারে। দেখ, দেখ…লোকটা ঘুরে দাঁড়ায়।
সুব্রত লোকটার পিঠের ওপরে টর্চের আলো ফেলে চমকে ওঠে, পিঠের ওপরে অজস্র বেত্রাঘাতের নির্মম চিহ্ন। কেটে কেটে চামড়ার ওপরে দাগ বসে গেছে। লোকটা প্রদীপ হাতে আবার ফিরে দাঁড়ায়—প্রদীপের আলোয় সুব্রত স্পষ্ট দেখতে পায়, লোকটার দুচোখের কোলে চক করছে অশ্রু।
আমি কিন্তু কাঁদি না। দোষ অবিশ্যি আমারই, আমারই বোঝা উচিত ছিল, দুধের মধ্যে লুকিয়ে ছিল বিষ—তীব্র বিষ, স্বেচ্ছায় তীব্র বিষ পান করেছি। প্রথমেই বুঝতে পারিনি, বুঝতে যখন পারলাম, তখন এখানে আমি বন্দী। দেখাতে পার—আমার খোকনকে একটিবার দেখাতে পার, বলতে পার কেমন দেখতে হয়েছে আজ সে!
কি জবাব দেবে সুব্রত বুঝতে পারে না।
সহসা তৃতীয় ব্যক্তির কণ্ঠস্বরে যেন ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হল। চকিতে সুব্রত পিছনদিকে তাকাল। কণ্ঠস্বর যে তার বিশেষ পরিচিত! কিন্তু সুব্রতর বিস্মিত কণ্ঠে কোনো স্বর বের হবার আগেই, আচমকা একটা ঠাণ্ডা জলীয় বাষ্পের মত কিছু ওর চোখেমুখে অজস্র কণায় এসে যেন একটা ঝাপটা দিল। সঙ্গে সঙ্গে ওর মাথাটা টলে উঠল।
আর সঙ্গে সঙ্গে সুব্রতর জ্ঞানহীন দেহটা হাঁটু দুমড়ে ভেঙে সশব্দে মাটিতে পড়ে গেল।
আগন্তুক বললে, কল্যাণবাবু, ভাবছ তোমায় আমি চিনতে পারিনি, তাই না!
আগন্তুক পকেট থেকে অতঃপর একটা শক্ত সরু সিল্ক-কর্ড বের করে জ্ঞানহীন ভূলুষ্ঠিত সুব্রতর হাত-পা বাঁধবার জন্য এগিয়ে এল।
এক মিনিট বন্ধু, অত তাড়াতাড়ি নয়!
আগন্তুক চকিতে দুপা পিছিয়ে এসে ঘুরে দাঁড়াল। মাত্র হাত পাঁচেক পশ্চাতে যে দাঁড়িয়ে, তার হাতে একটি ছোট্ট অটোমেটিক পিস্তল। এবং সেই ভয়ঙ্কর আগ্নেয় অস্ত্রটির চোং ওরই দিকে উদ্যত।
প্রথম ব্যক্তির বিস্মিত ভাবটা কেটে যেতেই বলে ওঠে, এ কি,তুমি!
হ্যাঁ, আমি। কল্যাণবাবুকে বাঁধবার আগে আমাদের মধ্যে পরস্পরের একটা মীমাংসা হওয়া একান্ত প্রয়োজন, নয় কি বন্ধু!
তার মানে?
মানে অতি সহজ। অত্যন্ত প্রাঞ্জল। আমি ভেবেছিলাম এই খেলার সঙ্গী বুঝি মাত্র আমিই একা। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, সেটা আমার ভুল। কিন্তু ভুল বোঝবার পর সে ভুলকে আর যে-ই বাড়তে দিক, শিবনারায়ণ চৌধুরী কখনও বাড়তে দেয় না। যার উপরে বিশ্বাস রেখে আমি আমার সব কিছু—এমন কি জীবন পর্যন্ত জামিন রেখেছিলাম, আজ যখন দেখতে পাচ্ছি তার কোনো মূল্যই নেই, তখন কেন আর এ মিথ্যা প্রহসনের বোঝ টেনে বেড়াই?
প্রথম ব্যক্তি যেন বোবা।
আজ এইখানে—এই অন্ধকূপের মধ্যেই রাত্রির অন্ধকারে তার শেষ মীমাংসা হয়ে যাক! দ্বিতীয় আগন্তুক বললে।
কিসের মীমাংসা তুমি আমার সঙ্গে করতে চাও শিবনারায়ণ?
এখনও কি বুঝতে পারনি?
হঠাৎ ওদের কথার মধ্যে একসময় পাগলটা ফিফিক করে হেসে ওঠে। দুজনেই চমকে ওঠে। শিবনারায়ণ সামান্য একটু চমকে বোধ হয় অন্যমনস্ক হয়েছিল, সেই মুহূর্তেই প্রথম ব্যক্তি বাঘের মত শিবনারায়ণের উপর লাফিয়ে পড়ে। জড়াজড়ি করে দুজনেই মাটিতে গিয়ে পড়ল। এবং ধস্তাধস্তি শুরু হল। এদিকে ঐ সময় পাগল হাতের সামনে কুলুঙ্গির ওপরে রক্ষিত পিলসুজটা তুলে নিয়ে প্রথমে শিবনারায়ণের মাথায় প্রচণ্ড ভাবে আঘাত করলে; শিবনারায়ণের চিৎকার মেলাতে না মেলাতেই পাগল অন্য লোকটির মাথায় প্রচণ্ড আঘাত হানল। সেও সঙ্গে সঙ্গে তীব্র একটা আর্ত চিৎকার করে জ্ঞাণহীন শিবনারায়ণের পাশেই সংজ্ঞাহারা হয়ে লুটিয়ে পড়ল।
দুজনের মাথা ফেটেই রক্ত ধূলিমলিন মেঝের ওপরে গড়িয়ে পড়ছে। পাগল আবার খিকখিক করে হেসে ওঠে। এতদিনের হত্যার রক্ততর্পণ হল বুঝি!
কিন্তু আর দেরি নয়, এই তো সুযোগ! পাগল শিবনারায়ণের দেহের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ওর জামার পকেট ও কটিবাস হাতড়াতে থাকে। কটিবন্ধে চাবির তোড়াটা গোঁজা ছিল। তাড়াতাড়ি সেই চাবি দিয়ে পায়ের বেড়ী খুলে ফেলল। আঃ মুক্তি, মুক্তি!
এতক্ষণে সুব্রতর জ্ঞানও একটু একটু করে ফিরে আসছে, সুব্রত পাশ ফিরে শুল।
পাগল সুব্রতর দেহ ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল, উঠুন, শুনছেন কল্যাণবাবু, উঠুন!
সুব্রত অতিকষ্টে চোখ মেলে তাকাল। চোখে তখনও ঘোর লেগে আছে একটা।
শুনছেন? উঠুন শীগগির, পালাতে হবে।
***
আধঘণ্টা পরে। তারা দুজনে তখনও রক্তাক্ত জ্ঞানহীন অবস্থায় অন্ধকার অন্ধকূপের মধ্যে পড়ে।
গুপ্তদ্বার বন্ধ করে সুব্রত ও পাগল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।
রাতটা শেষ হয়ে এল। পূবগগনে প্রথম আলোর ইশারা।
২.১০ ঘটনার সংঘাত
সুব্রত বুঝতে পেরেছিল, আর এখানে একটি মুহূর্তও থাকা নিরাপদ নয় এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নৃসিংহগ্রাম থেকে তাকে পালাতে হবে এবং কিরীটীকে গিয়ে সব কথা জানাতে হবে। সুব্রত আস্তাবলে যেখানে ঘোড়া দুটো বাঁধা থাকে সেখানে গেল। সহিসকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে, যত শীঘ্র সম্ভব ঘোড়ার জিন চড়াতে বলে, সুব্রত আবার প্রাসাদে ফিরে এল। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হয়ত দিনের আলো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে।