আজ্ঞে,…আ…আপনি…
সত্যি কথা বলছি, এই তো?… বেশ, শুনে সুখী হলাম। যাক্, আপনি ফিরতি শব্দ শোনার জন্য তাই জেগেই ছিলেন। কারণ জুতোর শব্দ শুনে প্রথম হতেই আপনি সন্দেহ। করেছিলেন যে, ছোষ্ট্র সিংয়েরই পায়ের শব্দ এবং সে কাউকে না জানিয়ে দরজা অরক্ষিত রেখে কোথাও যাচ্ছে। কেমন তাই না?
আ…আপনি কে?
সুবোধবাবু! সহসা কিরীটীর এতক্ষণের পরিহাস-তরল কণ্ঠ যেন যাদুমন্ত্রে কঠিন হয়ে ওঠে।
সুবোধ মণ্ডল ভীষণ রকম চমকে উঠে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
ময়াল সাপের গল্প শুনেছেন কখনও মণ্ডল মশাই? আপনি ময়াল সাপের খপ্পরে পড়েছেন। কিন্তু কোনো ভয় নেই আপনার। আপনাকে আমি ছেড়ে দিতে পারি, কিন্তু সে কেবল একটি শর্তে… আপনি সব কথা আমার কাছে এই মুহূর্তেই অকপটে আগাগোড়া খুলে বলবেন। তবেই, নচেৎ–
আজ্ঞে!–মণ্ডলের গলার স্বর কাঁপতে কাঁপতে থেমে যায়।
বলুন লোকটা যখন আবার ফিরে আসে, আধঘণ্টা পরে, তখন শব্দ শুনেই আপনি বাইরে এসে তাকে দেখতে পান কিনা?
হ্যাঁ—কিন্তু তাকে আমি চিনতে পারিনি। অন্ধকারে তাকে আমি ভাল করে দেখতে পাইনি।
সত্যি কথা বলছেন?
আজ্ঞে মা কালীর দিব্যি।
তারিণী খুড়ো যখন ঘর হতে বের হয়ে যান চিৎকার শুনে, তাও আপনি জানেন, কেমন না?
হ্যাঁ।
আপনি চিৎকার শুনে বের হননি কেন?
খুড়োকে যেতে দেখে আমি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম।
দরজা বন্ধ ছিল না?
আজ্ঞে না, খোলাই ছিল। খুড়ো দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে যেতে দেখেছি।
মহেশ সামন্ত—সে বুঝি তারিণীর পরেই যায়?
হ্যাঁ, ঠিক খুড়োর পিছুপিছুই গেছে।
আচ্ছা, আপনি এবার যেতে পারেন মণ্ডল মশাই। আপনার কোনো ভয় নেই। আমাকে আজ আপনি যা বললেন ঘুণাক্ষরেও কেউ তা জানতে পারবে না। এবং জানতে পারলেও, আপনি যাতে বিপদে না পড়েন সে ব্যবস্থা আমি করব কথা দিচ্ছি।
আপনি—
আমি কে, তাই জানতে চান তো? এবং কি করে আমি এসব জানলাম, না?
আজ্ঞে!
এইটুকু শুধু জানুন, জানাটাই আমার কাজ। গোপন রহস্য উদঘাটন করি বলেই আমার আর এক পরিচয় রহস্যভেদী!
সুবোধ মণ্ডল চলে যাবার পর, আরও আধঘণ্টা কিরীটী মহেশকে বসিয়ে রেখে, অবশেষে বিকাশকে ডেকে মহেশকে ছেড়ে দিতে বললে। তার আর জবানবন্দি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
২.০৯ পাতালঘরের বন্দী
সুব্রত প্রথমটা চমকেই উঠেছিল, কিন্তু বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে নিতে সুব্রতর বেশী সময় লাগল না। খোলা আলমারির মধ্যস্থিত আবিষ্কৃত সেই গুপ্ত পথের দিকে সুব্রত আরও একটু এগিয়ে গেল এবং হাতের জোরালো হান্টিং টর্চের আলো ফেললে। সামনে দেখতে পায়, ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে। একবার মাত্র সুব্রত ইতস্তত করলে, তারপরই এগিয়ে গেল সেই সিঁড়ির প্রথম ধাপটির পরে। অন্ধকার। নিকষকালো অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি যেন অন্ধ হয়ে যায়। সুব্রত আবার হাতের টর্চবাতি জ্বালল। দশ-বারোটা সিঁড়ি অতিক্রম করতেই সমতলভূমি পায়ে ঠেকল। কোন ভিজে স্যাঁতসেঁতে আলোবাতাসহীন ধূলামলিন ঘরের মেঝেতে যে ও পা দিয়েছে তা বুঝতে ওর কষ্ট হল না।
সুব্রত হাতের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিক দেখতে লাগল। অত্যন্ত নীচু ছাত, দাঁড়ালে সামান্য চার-পাঁচ ইঞ্চির জন্য মাথা ছাতে ঠেকে না, অল্পপরিসর একখানি ঘর, সামনেই একটা দরজা। হঠাৎ সেটা খুলে গেল। সামনে ও কে? ভূত না মানুষ! জীবিত না মৃত! ও কি পৃথিবীর কেউ, না অন্ধকার পাতাল গহ্বরের কোন বায়ুভূত প্রেতাত্মা তাকে ভয় দেখাবার জন্য সামনে এসে দাঁড়িয়েছে! সুব্রত বেশ ভাল করে চোখ দুটো একবার রগড়ে নিল।
আগন্তুক মাঝারি গোছের লম্বা। একমাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া কাঁচাপাকা চুল, কাঁচাপাকা রুক্ষ দাড়ি। খালি গা। পরনে ধূলিমলিন একখানি শতছিন্ন ধুতি। একটা বিশ্রী বোটকা গন্ধ তার গা থেকে বের হচ্ছে। চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। দুপায়ে মোটা লোহার শিকলের সঙ্গে লোহার বেড়ি আটকানো।
লোকটার চোখে সুব্রতর টর্চের আলো পড়তেই চোখ দুটো সে একবার বুজিয়েই আবার খুলে ফেলল। এবং পরক্ষণেই সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আচমকা ফিক ফিক করে হেসে উঠল। ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে সেই হাসির প্রতিধ্বনি যেন কি এক ভৌতিক বিভীষিকায় প্রেতায়িত হয়ে ওঠে। সুব্রতত থমকে যেতেই হঠাৎ টর্চের বোম থেকে হাতের আঙুল সরে গিয়ে দপ করে আলোটা নিভে যায়। কিন্তু আলো জ্বালাবার আগেই সুব্রতর নজরে পড়ে, খোলা দরজাপথে অন্ধকারে অতি ক্ষীণ একটা প্রদীপশিখা। ওপাশের ঘরের কুলুঙ্গিতে একটি পিলসুজের ওপরে পিতলের প্রদীপ জ্বলছে। নিচ্ছিদ্র আঁধারে যেন ঐ সামান্য প্রদীপের আলো অস্ফুট প্রাণস্পন্দনের মত করুণ ও অসহায় মনে হয়।
লোকটা হঠাৎ কথা বলে ওঠে, কে তুই? এখানে কি চাস্?
তুমি কে?
আমি!…ভুলে গেছি, মনে নেই ত, মনে আর পড়ে না আমি কে! সে কি আজকের কথা! হ্যাঁ, আজ ঠিক ছাব্বিশ বছর পূর্ণ হয়ে প্রথম দিন। দিন আমি গুনছি। ওই দেখ না দেওয়ালের গায়ে, এক এক মাস শেষ হয়েছে, আর হাতের আঙুল কামড়ে রক্ত বের করে সেই দেওয়ালের গায়ে একটা করে কালো দাগ কেটেছি। দেখ তো, দেখ তো—গুনে দেখ না! হিসাবে আমার ভুল নেই, ঠিক ছাব্বিশ বছর একদিন হল! রক্ত বলতে বলতে হঠাৎ লোকটা থেমে যায়, তারপর ঝঝ করে শিকলের শব্দ তুলে কুলুঙ্গির কাছে এগিয়ে গিয়ে পিলসুজ থেকে প্রদীপটা তুলে নিয়ে সুব্রতর একেবারে কাছ ঘেঁষে এগিয়ে আসে এবং প্রদীপটা সুব্রতর মুখের সামনে তুলে ধরে মৃদু সাবধানী কণ্ঠে বলে, ভয় পেলে? ভয় কি? ওরা আমায় পাগল সাজিয়ে রেখেছে বটে, কিন্তু বিশ্বাস কর—সত্যি সত্যি আমি পাগল নই! তুমি আমার খোকা-খোনকে দেখেছ? সমুদ্রের মত নীল, কাঁচের মত চকে দুটো চোখ! ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া মাথাভর্তি চুল! সবে তখন হাঁটতে শিখেছে, টলে টলে হাঁটত, আর নিজের আঘো-আধো স্বরে বলত, হাঁটি হাঁটি পা পা–খোকন হাতে দেখে যা! আমার খোকন–না, তুমি দেখনি। কেমন করে তুমি দেখবে তাকে? তোমার চোখের দৃষ্টিই বলছে আমার খোকনকে তুমি দেখনি!