কিরীটী আর কিছু বলল না।
.
সন্ধ্যার দিকে মহেশ সামন্ত ও সুবোধ মণ্ডল এল থানায়। তারিণী চক্রবর্তী ছিল না, আগের দিন কোনো এক মহালের কাজে গেছে।
প্রথমেই কিরীটী সুবোধকে ডাকলে, বসুন মণ্ডল মশাই।
আজ্ঞে স্যার, গরীব দাসানুদাস হই আমরা আপনাদের, আপনাদের সামনে উপবেশন করব, এ কি একটা লেহ্য কথা হল স্যার? কি আজ্ঞা হয় বলুন!
মণ্ডলের কথার বাঁধুনিতে কিরীটী না হেসে থাকতে পারলে না। বলে, মহাশয় বুঝি বৈষ্ণব? মাছ-মাংসও বুঝি চলে না? কিন্তু গলায় কষ্ঠি কই?
এ দাসের স্যার, সত্যি কথা বলতে কি, কোনো ধর্মের প্রতি আস্থাও যেমন নেই অনাস্থাও তেমন নেই। বোঝেনই তো স্যার, রাজবাড়ির বাজার-সরকার আমি!
তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তা সংসার-ধর্ম করেছেন, না এখনও বাজার-সরকারী করে সময় করে উঠতে পারেননি?
আজ্ঞে স্যার, সে দুঃখের কথা আর বলবেন না, তিন-তিনটি সংসার করেছিলাম, কিন্তু একটি কাশীবাসিনী, দ্বিতীয়া পিত্রালয়বাসিনী, কনিষ্ঠা উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করেছেন।
কেন চতুর্থী?
রামঃ, আর রুচি নেই স্যার।
আহা, আপনি তো তা হলে দেখতে পাচ্ছি রীতিমত একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি!
হেঁ হেঁ, কি যে বলেন স্যার, আমরা হলাম আপনাদের দাসানুদাস, কীট হতেও কীট।
তা দেখুন মণ্ডল মশাই, আমি কয়েকটা প্রশ্ন আপনাকে করতে চাই, ঠিক ঠিক যেন জবাব পাই, বিনয়ে বিগলিত হয়ে আবার সব না গোলমাল করে ফেলে অযথা নিজেকে বিপদগ্রস্ত করে ফেলেন! তবে হ্যাঁ, গরীব লোক আপনি সেকথা আমি ভুলবো না।
তা মনে রাখবেন বইকি স্যার, এ অধীন তো আপনাদের পাঁচজনের দয়াতেই বেঁচে-বর্তে আছে—তা কি আজ্ঞা হচ্ছে?
আপনাদের ম্যানেজার সতীনাথ লাহিড়ী মশাই যে রাত্রে খুন হন, সেই রাত্রির কথা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে?
সহসা যেন কিরীটীর কথায় মণ্ডলের মুখখানি কেমন পাংশুবৰ্ণ ভাব ধারণ করে, কিন্তু মুহূর্তে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, তা…তা আছে বইকি স্যার!
আচ্ছা মণ্ডলমশাই, দারোগাবাবুর কাছেসেরাত্রে আপনি আপনার জবানবন্দিতে বলেছিলেন, সতীনাথ লাহিড়ী মরার আগে যে চিৎকার করে উঠেছিলেন, সেই চিৎকার শুনেই আপনি ঘর থেকে বের হয়ে যান। অথচ তারিণী খুড়োর পাশের ঘরে থেকেও আপনি জানতে পারেননি, কখন তারিণী চক্রবর্তী ঘর থেকে বের হয়ে যান? আপনি তখন জেগেই ছিলেন, কেমন তাই না?
না, বোধ হয় তো আমি ঘুমিয়েই ছিলাম।
বেশ ভাল করে মনে করে দেখুন, মনে হচ্ছে যেন আমার, বোধ হয় কেন—নিশ্চয়ই আপনি জেগেই ছিলেন, মোটেই ঘুমোননি!
আজ্ঞে স্যার, তা কি করে হয়? ঘুমিয়ে থাকলেও জেগে থাকা কি করে সম্ভব বলুন?
সম্ভব এইজন্য যে চিৎকারটা আপনি বেশ পরিষ্কারই শুনতে পেয়েছিলেন। ঘুমিয়ে থাকলে কি কেউ চিৎকার শুনতে পায়? এবং শব্দটা শুনতে পেয়েছিলেন বলেই এটাও জানেন, আপনার তারিণী খুড়ো কখন ঘর থেকে বের হয়ে যান! বুঝলেন মণ্ডল মশাই, একে বলে আইনের লজিক। ঠিক আপনি বুঝতে পারবেন না, কারণ লজিক তো আর আপনি পড়েননি। যাহোক আমাদের লজিকে বলে চিৎকারটা যখন শুনেছেন, এবং জেগে না থাকলে যখন চিৎকারটা শোনা যায় না, তখন আপনি কি করে ঘুমিয়ে থাকতে পারেন? অতএব জেগেই ছিলেন। কেমন,এবার হল তো? বেশ, এবারে বলুন তো, শুধু যে আপনার তারিণী খুড়োকেই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে শুনেছিলেন তা নয়, আরও কাউকে বারান্দা দিয়ে হেঁটে যেতেও শুনেছিলেন যার পায়ের জুতোর তলায় লোহার নাল বসানো ছিল।
সুবোধ বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কি যে জবাব দেবে কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারে না।
মণ্ডল মশাই, আপনি যে একজন নিরীহ গোবেচারী গোছের লোক তা আমি জানি। কারও সাতেও নেই আপনি, কারও পাঁচেও নেই। অথচ কেমন বিশ্রীভাবে আপনি এই খুনের মামলায় জড়িয়ে যাচ্ছেন তা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতেন, তাহলে হয়ত ভুলেও বলতেন না যে আপনি সেরাত্রে বোধ হয় ঘুমিয়ে ছিলেন। তাছাড়া এ-কথা কে না বোঝে, খুনের মামলায় জড়িয়ে যাওয়া কত বড় সাংঘাতিক ব্যাপার! চাই কি যোগসাজস আছে প্রমাণ হয়ে গেলে, সারাটা জীবন কাষ্ঠঘানি ঘুরিয়ে সরিষা হতে বিশুদ্ধ সরিষার তৈলও উৎপাদন করতে হতে পারে। এবং সেও আর চারটিখানি কথা নয়, কি বলুন!
স্যার, একটা বিড়ি পান করতে পারি? গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে।
আহা, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। সে কি কথা? ম্যাচ আছে, না দেব?
কিরীটী লক্ষ্য করে দেখলে, বিড়ি ধরাচ্ছে বটে সুবোধ কিন্তু কি এক গভীর উত্তেজনায়। হাত দুটো তার ঠকঠক করে কাঁপছে।
মণ্ডল মশাই, এবারে বোধ হয় আপনি বসতে পারবেন, ঐ চেয়ারটায় বসুন। তারপর আপনার আর কষ্ট করতে হবে না, আমিই বলছি শুনুন। যদি কোথাও ভুল থাকে দয়া। করে শুধরে দেবেন। সেইদিন রাত্রে মানে যেদিন আপনাদের ভূতপূর্ব ম্যানেজার লাহিড়ী মশাই খুন হন, সেদিন এই রাত্রি দশটা কি পৌনে দশটার সময়, প্রথমে আপনি একটা শব্দ শুনতে পান, ঠিক যেন জুতো পায়ে দিয়ে কেউ বারান্দা দিয়ে হেঁটে বাইরের দিকে চলে যাচ্ছে। জুতোর শব্দ ঠিক অনেকটা আপনাদের ছোট্টু সিংয়ের লোহার নাল বসানো নাগরাই জুতোর শব্দের মত। কিন্তু কিছু আপনি মনে করেননি, তার কারণ আপনি ভেবেছিলেন ছোট্টু সিং-ই বাইরে যাচ্ছে। তারপর অনেকক্ষণ আপনি কান পেতে অপেক্ষা করেছেন, কারণ আপনি জানতেন, রাত্রে মানে ঠিক সন্ধ্যার পর হতে ঐ দরজার প্রহরা ছেড়ে ছোষ্ট্র সিংয়ের বাইরে কোথাও যাওয়ার হুকুম নেই এবং যদি সে হুকুম না মেনে দরজা ছেড়ে মুহূর্তের জন্যও কোথাও যায় ও,সেকথা যদি ম্যানেজারবাবু জানতে পারেন, তাহলে তার চাকরি তো যাবেই জমানো মাইনেটাও কাটা যাবে। এখানে হপ্তায় দুবার হাট করে রাজবাড়ির সাতদিনের মত অনেক কিছু জিনিস কিনেকেটে আপনি আনেন, কিন্তু ম্যানেজারবাবু আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন না বলে তিনি ছোট্টু সিংকে আপনার সঙ্গে যেতে আদেশ দেন। কাজে-কাজেই ছোট্টু সিংয়ের ওপরে আপনার সন্তুষ্ট না থাকা খুবই স্বাভাবিক। এবং আপনি সর্বদা চেষ্টা করছিলেন কি করে ছোট্টু সিংকে জব্দ করা যেতে পারে। কি, আমি কিছু মিথ্যে কথা বলছি, বলুন?