এবারে কিরীটী প্রশ্ন করে, চিৎকার শোনবার পর আপনি যখন ঘরে গিয়ে প্রবেশ করেন, আপনার কাকা তখনও বেঁচেছিলেন, না তার আগেই মারা গেছেন?
আমি গিয়ে আর তাঁকে জীবিত অবস্থায় দেখিনি।
আপনার এ ঘর থেকে সেই ঘরে যেতে কতক্ষণ সময় লাগতে পারে বলে আপনার মনে হয় রাজাবাহাদুর?
তা মিনিট পাঁচ-ছয় তো হবেই।
চিৎকার শুনেই আপনি ছুটে গিয়েছিলেন, বললেন না? একটুও দেরি করেননি?
হ্যাঁ।
আপনার এ ঘর থেকে সে ঘরে কোন চিৎকারের শব্দ হলে অনায়াসেই তবে শোনা যায় বলুন।
নিশ্চয়ই।
আর কে কে সেই চিৎকার শুনতে পেয়েছিল জানেন?
বোধহয় অনেকেই শুনেছিল, কেননা আমরা মানে আমি ও আমার বিমাতা সে ঘরে গিয়ে ঢোকবার পর কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির চাকরবাকরেরাও ছুটে এসেছিল।
রাজাবাহাদুর,আপনার যদি আপত্তি না থাকে, আমি রাণীমাকে, মানে আপনার বিমাতাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
বিশেষ কি প্রয়োজনীয়?
হ্যাঁ। তা নাহলে অযথা তাঁকে আমি কষ্ট দিতাম না।
বেশ, তাঁকে ডাকাচ্ছি।
২.০৭ রাণীমা
রাজাবাহাদুর একজন ভৃত্যকে রাণীমাকে ডাকতে পাঠালেন। একটু পরেই রাণীমা মালতী দেবী ধীর মন্থর পদে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। কিরীটী চোখ তুলে মালতী দেবীর দিকে তাকাল।
মালতী দেবী সত্যিই অপরূপ রূপলাবণ্যময়ী, বয়েস এখনও চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে, ছোটখাটো গড়ন, অত্যন্ত শীর্ণ। মুখখানি যেন শিল্পীর পটে আঁকা ছবির মত নিখুঁত। পরিধানে একটি দুধ-গরদ থান, নিরাভরণা। কিন্তু একটা জিনিস, মুখের দিকে তাকালেই মনে হয়, অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সহিষ্ণু।
মা, আপনাকে আমার প্রয়োজনের তাগিদে বিরক্ত করতে হল বলে আমি একান্ত দুঃখিত, কিরীটী বলে, বেশীক্ষণ আপনাকে কষ্ট দেব না মা। দু-চারটে প্রশ্ন শুধু আমি করতে চাই, আশা করি ছেলের অপরাধ নেবেন না।
বলুন। শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে মালতী দেবী বললেন।
এবারে কিরীটী ঘরের মধ্যে উপস্থিত বিকাশ ও রাজাবাহাদুরের দিকে তাকাল। অনুগ্রহ করে, কিরীটী মৃদুস্বরে বললে, আপনারা যদি দু-চার মিনিটের জন্য একটু বাইরে যান।
জবাবে বিকাশই রাজাবাহাদুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, আসুন রাজাবাহাদুর।
দুজনে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন। কিরীটী এগিয়ে গিয়ে দরজাটি ভেজিয়ে দিল। তারপর মালতী দেবীর দিকে এগিয়ে এসে মৃদুকণ্ঠে বললে, মা, আমি আপনার কাছে কয়েকটি কথার জবাব চাই।
আপনি কথা বলতে পারেন স্বচ্ছন্দে। কেননা এ ঘরটি এমনভাবে তৈরী যে, চিৎকার করে কথা বললেও এ ঘরের বাইরে শব্দ যায় না। এই ঘরের দেওয়ালগুলো সকল শব্দকেই শুষে নেয়। আবার এর পাশের ঘরটি এমনভাবে তৈরী যে, আশেপাশের দুটি ঘর ও ঠিক তার নীচের ঘরের সমস্ত শব্দ যত আস্তেই হোক না কেন অনায়াসেই শোনা যাবে। ঘর দুটি এভাবে আমার স্বামীই তাঁর জীবিত অবস্থায় জার্মান ইঞ্জিনীয়ার দিয়ে প্ল্যান করে তৈরী করেছিলেন।
আশ্চর্য তো! কিন্তু এইভাবে ঘর দুটি তৈরী করার কারণ?
কারণ এই ঘরটিতে বসে তিনি স্টেট সংক্রান্ত সকল শলাপরামর্শ গোপনে করতেন, আর পাশের ঘরটিতে তিনি শয়ন করতেন বলে যাতে করে সামান্যতম শব্দও শুনতে পান, তাই ঐ ব্যবস্থা করেছিলেন।
আপনার স্বামী অত্যন্ত দূরদর্শী ছিলেন দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সে কথা থাক। নিশানাথবাবুর চিৎকার শুনেই আপনি তাঁর ঘরে ছুটে যান, কেমন তাই না?
একটু ইতস্তত করে মালতী দেবী মৃদুকণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ।
আপনি কোন ঘরে তখন ছিলেন?
রন্ধনশালার দিকে। আমি ওঁর খাবার সাজাচ্ছিলাম, আমার হাতে ছাড়া ঠাকুরপো কারও হাতে খেতে চাইতেন না ইদানীং।
কেন?
তাঁর কেমন একটা ধারণা হয়তো ছিল, তাঁকে এরা বিষ খাইয়ে মারতে চায়।
কেন, এ রকম ধারণার কোনো কারণ ঘটেছিল কি?
এবার যেন বেশ একটু ইতস্তত করেই মালতী দেবী জবাব দিলেন, না, আমার মনে হয়, ইদানীং তাঁর মাথার একটু দোষ হয়েছিল, তাই হয়ত ঐসব আবোলতাবোল ভাবতেন। কে এমন এ বাড়িতে আছে বলুন যে তাঁকে বিষ খাইয়ে মারতে চাইবে! ঐসব তাঁর বিকৃত মস্তিষ্কের কল্পনা।
সত্যিই আপনার তাই বলেই মনে হয় রাণীমা?
হ্যাঁ।
শুনেছি রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিকই তাঁকে মাথা খারাপ হওয়ার পর আগ্রহ করে রায়পুরে নিয়ে আসেন।
হ্যাঁ, বিনয় ওকে অত্যন্ত ভক্তিশ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত, আমার দুই দেবরের মধ্যে একমাত্র উনিই এদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। ওদের আর এক কাকা যিনি এখানেই আছেন, তিনি এদের সঙ্গে কখনও কথা পর্যন্ত বলেন না। শুনেছি পথেঘাটে দেখা হলেও চোখ ফিরিয়ে নেন।
কিন্তু আমি তো শুনেছি হারাধন মল্লিক লোকটি ভাল।
তা হতে পারে।
আচ্ছা মা, চিৎকার শুনে ছুটে গিয়ে নিশানাথবাবুকে জীবিত দেখেছিলেন, না মৃত দেখেছিলেন?
মালতী দেবী চুপ করে রইলেন। কোনো জবাব দিলেন না।
বলুন—
আমি…না, তাঁকে আমি জীবিত দেখিনি, আমি যখন ঘরে গেছি, তাঁর দেহে তখন আর প্রাণ ছিল না। প্রথম দিকে একটু ইতস্তত করে শেষের দিকে কতকটা যেন অস্বাভাবিক জোর দিয়েই মালতী দেবী কথাগুলো বলে গেলেন।
কিরীটী অল্পক্ষণ কি যেন একটু চিন্তা করলে, তারপর সমস্ত সংকোচকে একপাশে ঠেলে ফেলে হঠাৎ প্রশ্ন করলে, মা, আমার মুখের দিকে তাকান তো। আমি আপনার সন্তানের মত। কোনো লজ্জা বা সংকোচ করবেন না। কয়েকটা পুরানো কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই। জানি কথাগুলো আপনার ভাল লাগবে না। শুনলে হয়তো বা ব্যথা পাবেন, কিন্তু আমারও না জিজ্ঞাসা করলে চলবে না। একান্ত নিরুপায় আমি।