কথা বলতে বলতে দুজনে প্রায় প্রাসাদের বড় গেটটার সামনে এসে গেছে ততক্ষণ।
গেটের বাইরে ছোষ্ট্র সিং পাগড়ী মাথায় লাঠি হাতে দাঁড়িয়েছিল, সেলাম দিল। গেটের বড় আলোটা জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় তীব্র দৃষ্টি বুলিয়ে ছোট্টু সিং-এর আপাদমস্তক কিরীটী দেখে নিলে একবার। সুব্রতর চিঠির বর্ণনা তার মনে ছিল, ছোষ্ট্র সিংকে চিনতে এতটুকুও তার কষ্ট হয়নি। ছোট্টু সিং-এর পাশেই সুবোধ মণ্ডলও গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল। ওরা কারও দিকে দৃষ্টিপাত না করে গেট অতিক্রম করে এগিয়ে চলে। খাজাঞ্জীঘরের সামনে মহেশ সামন্ত ও আর একজন দাঁড়িয়ে ফিসফিস্ করে কি সব কথাবার্তা বলছিল, ওদের এগিয়ে আসতে দেখে হঠাৎ চুপ করে গেল।
কিরীটী চাপা গলায় প্রশ্ন করলে, এরা?
প্রথমটি জানি না, দ্বিতীয়টি মহেশ সামন্ত।
ও, এরাই তারা! আর গেটের সামনে যে দাঁড়িয়েছিল, একজন তো ছোট্টু সিং, দ্বিতীয়টি?
সুবোধ মণ্ডল।
ও, যে জেগেই ঘুমোয়!
দু-চারবার আসা-যাওয়া করতে করতে বিকাশের রাজবাড়ির অন্দরমহলটা বেশ পরিচিত হয়ে গিয়েছিল, সোজা সে কিরীটীকে সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল।
সেদিনকার মত আজও রাজাবাহাদুরের বাসভৃত্য শম্ভ সিঁড়ির মাথায়ই দাঁড়িয়ে ছিল, বোধ করি ওদেরই অপেক্ষায়।
রাজাবাহাদুর কোথায়?
আজ্ঞে তাঁর বসবার ঘরে।
অস্থিরভাবে রাজাবাহাদুর পায়চারি করছিলেন, ওদের পদশব্দে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন, আসুন বিকাশবাবু! পরক্ষণেই কিরীটীর প্রতি নজর পড়তে ভুরুটা ঈষৎ কুঁচকে থেমে গেলেন।
কিরীটীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেটা কিন্তু এড়ায়নি। সে মৃদু হেসে একটু এগিয়ে এসে বললে, আমার নাম অর্জুন রায়।
বিকাশই এব বাকি পরিচয়টুকু শেষ করে দিল, আমারই ভুল হয়েছে রাজাবাহাদুর, ইনি সি.আই.ডি-র ইন্সপেক্টর মিঃ অজুর্ন রায়, লাহিড়ীর কেসের তদন্তে সাহায্য করবার জন্য হেড কোয়াটার থেকে এখানে এসেছেন আজ দিন-দুই হল, আর ইনি মহামান্য রাজাবাহাদুর শ্ৰীযুক্ত সুবিনয় মল্লিক, রায়পুর স্টেটের।
এরপর উভয়ে উভয়কে নমস্কার ও প্রতিনমস্কার জানাল। কিন্তু কিরীটী লক্ষ্য করলে, তথাপি যেন রাজাবাহাদুরের মুখ হতে সম্পূর্ণ বিরক্তির ভাবটা যায়নি। কিরীটী সেদিকে আর বেশী নজর দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করল না। এবং বর্তমান কেস সম্পর্কে যে তার বিশেষ একটা কিছু উৎসাহ আছে সে ভাবও প্রকাশ করতে চাইল না। মুখের উপর একটা প্রশান্ত নির্লিপ্ততার ভাব টেনে এনে নিঃশব্দে একপাশে সরে রইল।
বিকাশের প্রশ্নেরই জবাবে সুবিনয় মল্লিক বলেন, মৃতদেহ নিশ্চয়ই আপনারা দেখতে চান। দারোগা সাহেব?
নিশ্চয়ই।
তবে যে ঘরে মৃতদেহ আছে সেই ঘরেই সকলকে যেতে হয়, কেননা যে ঘরে খুড়ো মশাই থাকতেন, সেই ঘরেই তিনি নিহত হয়েছেন।
বেশ, তবে তাই চলুন। মিথ্যে আর দেরি করে লাভ কি! বিকাশ বললে।
একটু অপেক্ষা করুন রাজাবাহাদুর। কিরীটী গমনোদ্যত সুবিনয় মল্লিক ও বিকাশকে বাধা দিল।
ওঁরা দুজনেই একসঙ্গে ফিরে দাঁড়াল। দুজনের চোখেই সপ্রশ্ন দৃষ্টি।
মৃতদেহ দেখার জন্য তাড়াহুড়োর কিছুই নেই, কারণ যিনি মারা গেছেন, তিনি যখন নিঃসন্দেহেই মারা গেছেন, তখন আগে সমস্ত ব্যাপারটা একবার শুনতে পারলে ভাল হত। তারপর রাজাবাহাদুরের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, একটুও কিছু বাদ না দিয়ে সব ব্যাপারটা খুলে বলুন তো!
রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক যা বললেন সংক্ষেপে তা এই, বিকাশবাবুর মুখেই হয়ত শুনে থাকবেন, আমার কাকা নিশানাথ মল্লিক শোলপুর স্টেটের আর্টিস্ট ছিলেন, কিছুদিন হল মাথার সামান্য গোলমাল হওয়ায় স্টেটের চাকরি ছাড়িয়ে আমি তাঁকে একপ্রকার জোরজবরদস্তি করে রায়পুরে নিয়ে আসি। রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিকরা ছিলেন তিন ভাই। বড় শ্ৰীকণ্ঠ, মেজ সুধাকণ্ঠ ও কনিষ্ঠ বাণীকণ্ঠ। শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের পিতা রত্নেশ্বর মল্লিক, কোনো কারণে মধ্যম ও কনিষ্ঠ পুত্রের উপর বিরূপ হয়ে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি জ্যেষ্ঠ শ্রীকণ্ঠ মল্লিককেই দিয়ে যান। মধ্যম ও কনিষ্ঠের জন্য সামান্য কিছু মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিয়ে যান মাত্র। সুধাকণ্ঠ ছিল অত্যন্ত আত্মাভিমানী, পিতার ব্যবহারে বোধ হয় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি তাঁর একমাত্র মাতৃহারা পুত্র হারাধনকে নিয়ে ভাগলপুরে চলে যান। এবং সেখানে যাবার কয়েক বৎসর পর হারাধন যেবারে এন্ট্রান্স পাস দেন সেবারে মারা যান। তখন হারাধন মোক্তারী পাস করে কিছুকাল ভাগলপুরে প্র্যাকটিস করেন, তারপর রায়পুরে এসে প্র্যাকটিস ও বসবাস শুরু করেন। এদিকে রত্নেশ্বরের মৃত্যুর দু মাস পরেই কনিষ্ঠ বাণীকণ্ঠ ও তাঁর স্ত্রী, একমাত্র পুত্র নিশানাথকে রেখে মারা যান। নিশানাথ আর্ট স্কুল থেকে পাস করে কিছুকাল পরে শোলপুরে চাকরি নিয়ে চলে গেলেন। আমার এখানে এসেছিলেন মাস পাঁচেক মাত্র। আমি যেদিন হঠাৎ আততায়ীর হাতে আহত হই, সেদিন থেকে কাকার পাগলামিটা ক্রমশই বেড়ে ওঠে, এবং সর্বদা তাঁকে দেখাশুনা করছিলেন আমার বিমাতা। আজ দ্বিপ্রহর থেকে চুপচাপই ছিলেন। অন্যান্য দিনের চেয়ে। সন্ধ্যা থেকে রাত্রি নটা পর্যন্ত মা কাকার কাছেই ছিলেন। রাত্রি নটার পর মা কাকার খাবার আনতে গেছেন, এমন সময় হঠাৎ একটা চিৎকার শোনা যায়, আমি এই ঘরে বসেই সংবাদপত্র পড়ছিলাম, আমিও চিৎকার শুনে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি আমার বিমাতাও ততক্ষণে সেই কক্ষে গিয়ে হাজির হয়েছেন। কাকা জানালার নীচে উপুর হয়ে পড়ে আছেন। তাড়াতাড়ি কাকাকে গিয়ে ধরতেই, দেখলাম বুকের কাছে জামা ও মেঝেতে রক্ত। এবং বাঁদিকের বুকে বিঁধে আছে একটা তীর। ঠিক যেমনটি বিঁধেছিল লাহিড়ীর বুকে। বুঝলাম হতভাগ্য লাহিড়ীর মতই তাঁরও মৃত্যু ঘটেছে এবং তাতে কোনো অদৃশ্য আততায়ীর হাত আছে। তখুনি আপনার কাছে লোক পাঠাই।