বিকাশও সুব্রতর অনুপস্থিতিতে কিরীটী ওর বাসায় উঠে আসায় বিশেষ খুশীই হয়েছিল, এবং কিরীটীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় রায়পুর হত্যা-মামলায়ও বিশেষ আগ্রহান্বিত হয়ে উঠেছিল ক্রমে। কিরীটীর তীক্ষ্ণ বিচারশক্তি, অদ্ভুত বিশ্লেষণ-ক্ষমতা ওকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু দুদিন আগে সুব্রতর বাসায় কিরীটীকে যে কথার নেশায় পেয়েছিল, এখন যেন তার তিলমাত্রও তা ওর মধ্যে অবশিষ্ট নেই। শামুকের মত হঠাৎ যেন কিরীটী নিজেকে খোলসের মধ্যে গুটিয়ে নিয়েছে।
দিনরাত কিরীটী ঘরে বসে বসে আপন মনে চোখ বুজে হয় কিছু ভাবে, না হয় একটা কালোমোটা নোটবইতে খসখস করে কি সব লিখে চলে।
সন্ধ্যাবেলা থানার সামনে মাঠের মধ্যে দুজনে যখন মধ্যে মধ্যে ইজিচেয়ার পেতে বসে, তখনও বেশীর ভাগ সময়ই কিরীটী আজেবাজে গল্প করেই কাটিয়ে দেয়। মামলার ধার দিয়ে যায় না।
রাত্রি তখন প্রায় গোটা এগারো সাড়ে এগারো হবে। বিকাশ ও কিরীটী আহারাদির পর যেখানে গাছের তলে অন্ধকারে চেয়ার পেতে বসে গল্প করছিল, সেখানে হঠাৎ একটা তীব্র আলোর রশ্মি এসে পড়ল।
দেখুন তো বিকাশবাবু, সাইকেলে করে এত রাত্রে কে এল? কিরীটী বললে।
সত্যিই একটা সাইকেল এসে ওদের অল্পদূরে থামল, এবং সাইকেল-আরোহী নীচে লাফিয়ে পড়ল।
কে? বিকাশ প্রশ্ন করে।
আজ্ঞে, আমি সতীশ স্যার। সতীশ এগিয়ে আসে।
কি সংবাদ, এত রাত্রে?
আজ্ঞে–খুব জোরে অনেকটা পথ সাইকেল চালিয়ে এসে সতীশ বেশ হাঁপিয়ে গিয়েছিল। টেনে টেনে বলে, আজ্ঞে রাজাবাহাদুর পাঠিয়ে দিলেন, রাজাবাহাদুরের খুড়োমশাই নিশানাথবাবুকে তার শোবার ঘরের মধ্যে কারা যেন বুকে তীর মেরে, আমাদের লাহিড়ী মশায়ের মতই খুন করে রেখে গেছে। এক নিঃশ্বাসে সতীশ কথাগুলো বলে শেষ করে।
সংবাদটা শুনে বিকাশ হঠাৎ যেন লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, অ্যাঁ, কি বললে সতীশ! আবার…আ…বা…র খুন!
আজ্ঞে।
তারপর একটু থেমে সতীশ বললে, আপনি একবার তাড়াতাড়ি চলুন স্যার। রাজাবাহাদুর বড্ড নার্ভাস হয়ে পড়েছেন।
আচ্ছা তুমি এগোও, বলল আমি এখুনি আসছি।
সতীশ চলে গেল।
বিকাশবাবু? কিরীটী ডাকলে মৃদুস্বরে।
বলুন?
আমিও যাব আপনার সঙ্গে রাজপ্রাসাদে।
অ্যাঁ! সে কি করে হতে পারে?
শুনুন। আপনি আমার পরিচয় দেবেন সি.আই.ডি-র ইন্সপেক্টর বলে? বলবেন, এই কেসেরই তদন্ত করতে উপরওয়ালারা আমাকে আপনার সাহায্যে পাঠিয়েছেন কলকাতা থেকে। ইন্সপেক্টার অর্জুন রায় বলে আমার পরিচয় দেবেন।
ঠিক আছে। চলুন। আপনি হয়ত অকুস্থানে গেলে নিজের চোখে পরীক্ষা করলে, অনেক কিছুই দেখতে পাবেন।
সত্যি কথা বলতে কি, বিকাশ কিরীটীর এ প্রস্তাবে যেন হাতে স্বর্গ পেল। কিরীটী সঙ্গে থাকা, শুধু বলই নয়, একটা ভরসাও।
কিরীটীকে ঐ বেশেই গমনোদ্যত দেখে বিকাশই হঠাৎ প্রশ্ন করে, আপনি কি এই বেশেই যাবেন?
হ্যাঁ, সাধারণ ড্রেসেও অনেক সময় সি.আই. ডি-র লোকদের.ঘুরতে হয়। তাছাড়া আরও একটা কথা, আমার অর্জুন রায় পরিচয় একমাত্র রাজাবাহাদুরকে ছাড়া আর কাউকেই দেবেন না। তাঁকেই শুধু আড়ালে ডেকে চুপিচুপি বলে দেবেন। এত বড় সুযোগ সহজে মেলে না। তারপরই যেন কতকটা অস্ফুট কণ্ঠে কিরীটী বলতে থাকে, আমি জানতাম, নিশানাথের দিনও ঘনিয়ে এসেছে; তবে তা এত শীঘ্র তা ভাবিনি। ভেবেছিলাম বিকৃতমস্তিষ্ক বলে হয়ত কিছুদিন সে রেহাই পাবে, কিন্তু এখন দেখছি আমারই হিসাবে ভুল হয়েছিল।
বিকাশ কিরীটীর অর্ধস্ফুট স্বগতোক্তিগুলি ভালকরে বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে, কি বলছেন?
কিরীটী মৃদু স্পষ্ট কণ্ঠে জবাব দেয়, না, ও কিছু না। ভাবছিলাম জীবিত অবস্থায় নিশানাথের সঙ্গে একটিবার দেখা করতে পারলে তদন্তের আমাদের অনেক সুবিধা হত, কিন্তু যেমনটি চাওয়া যায় সব সময় তো তেমনটি হুবহু হয় না। হাতের কাছে যেটুকু পাওয়া গেল তারই পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা যাক। এখন উঠুন, আর দেরি নয়…
সামান্য চেহারার অদলবদল করে নিল কিরীটী দ্রুতহস্তে ঘরের মধ্যে ঢুকে। তারপর দুজনে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল রাজপ্রাসাদের উদ্দেশে।
নিঃশব্দে দুজনে পথ অতিবাহিত করে চলেছে, কারও মুখেই কোনো কথা নেই। হঠাৎ একসময় বিকাশ ডাকে, কিরীটীবাবু!
উঁহু, কিরীটী নয়, বলুন অর্জুনবাবু! খুব সাবধান, কিরীটী নামটা অত্যন্ত পরিচিত। যদিও সামান্য চেহারার অদলবদল করে নিয়েছি, তবু সাবধানের মার নেই।
না, আর ভুল হবে না, চলুন।
হ্যাঁ, কি যেন বলছিলেন বিকাশবাবু?
আচ্ছা আপনার কি মনে হয়, খুনী এখনও আশেপাশেই কোথাও আছে গা-ঢাকা দিয়ে?
কিরীটী হো-হো করে হেসে ওঠে, কেমন করে বলি বলুন তো! আমি তো আর গণকঠাকুর নই!
কিন্তু অনেক সময় শুনেছি, খুনীরা খুন করবার পর অবস্থা বোঝবার জন্য অকুস্থানের আশেপাশেই কোথাও আত্মগোপন করে থাকে।
বুঝেছি, আপনি কি বলতে চান বিকাশবাবু। কিন্তু সময় না হওয়া পর্যন্ত খুনীকে ধরা যায় না; তাহলে সব কেঁচে যায়। খুনী যদি এখন ওইখানে থাকেও, তবু জানবেন এখনও তাকে ধরবার মাহেন্দ্রক্ষণটি আসেনি। ভয় নেই, লগ্ন এলেই বরকে পিড়িতে বসাব এনে। কিরীটী রায় লগ্ন বয়ে যেতে দেয় না কখনও। কিরীটী স্মিতভাবে বললে।
কিরীটী আবার বলতে থাকে, তাছাড়া ভেবে দেখুন, খুনীকে ধরে ফেলবার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত রহস্যের সব উত্তেজনা বা আনন্দের সমাপ্তি ঘটল। চিন্তা করে দেখুন তো খুনী কে আপনি জানতে পেরেছেন এবং জেনেও না-জানার ভান করে আছেন, খুনীকে সহজ নিশ্চিন্ত ভাবে চলে-ফিরে বেড়াবার জন্য। সে পরম নিশ্চিন্তে আছে। একবারও সে ভাবছে না যে, একজনের চোখে সে ধরা পড়ে গেছে। একজনের সদাসতর্ক দৃষ্টি সর্বক্ষণ তার পিছু পিছু ফিরছে ছায়ার মত। তারপরই যেই সময় এল, প্রমাণগুলো সব আপনার হাতের মুঠোর মধ্যে এল, ঝাঁপিয়ে পড়ুন আপনি খুনীর উপরে।