আমি সবই জানি বাবা, প্রমাণিত ঠিক না হলেও প্রমাণিত ধরে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া এও জানি, এ ধরনের রায় আবার উচ্চতর আদালতে নাকচও হয়ে গেছে বহুবার। সেই আশাতেই তোমার শরণাপন্ন হয়েছি বাবা।
বলুন মা, এ ব্যাপারে কিভাবে ঠিক আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি?
তোমার সঙ্গে ঠিক চাক্ষুষ পরিচয় না থাকলেও, তোমার সম্পর্কে অনেক শুনেছি, অনেকখানি আশা বুকে নিয়েই তোমার কাছে এসেছি। তুমি আমার ছেলেকে মুক্ত করে এনে দাও বাবা। জীবনে আমার মুখ দিয়ে কোনো দিনও মিথ্যা কথা বের হয়নি। আমি জানি, ছেলে আমার। নির্দোষ। ঘটনার দুর্বিপাকে সে এই হত্যার মামলায় জড়িয়ে পড়েছে। তাকে বাঁচাও।
স্নেহসিক্ত কাকুতিতে ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর যেন শেষের দিকে রুদ্ধ হয়ে আসে। কিরীটী ঠিক কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না। ঘরের মধ্যে একটা দুঃসহ স্তব্ধতা যেন থমথম করে। বাইরে জমাট-বাঁধা শীতের অন্ধকার।
ভদ্রমহিলা আবার একসময় বলতে শুরু করেন, বড় দুঃখে তাকে আমি মানুষ করেছি বাবা। ওইটিই আমার একমাত্র সন্তান; ওর বয়স যখন মাত্র তিন বৎসর তখন আমার স্বামী অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন।
কিরীটী যেন ওর শেষের কথা কটি শুনে হঠাৎ চমকে ওঠে। বলে, কি বললেন?
ভদ্রমহিলা কিরীটীর আকস্মিক প্রশ্নে বিস্মিতভাবে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরভাবে বললেন, বলছিলাম আমার স্বামীর কথা।
কিরীটী আবার ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললে, গোড়া থেকে সব কথা আমাকে যথাসম্ভব খুলে বলুন তো মা।
গোড়া থেকে বলব?
হ্যাঁ, এইমাত্র আপনার স্বামীর কথা যা বলছিলেন, সব একেবারে গোড়া থেকে বলুন।
১.০২ পুরাতনী
ভদ্রমহিলা ধীর শান্ত স্বরে বললেন, সব জানতে হলে সবার আগে তোমাকে রায়পুরের ইতিহাস জানতে হবে, কিন্তু সে-সব কথা আগাগোড়া বলতে গেলে রাত্রি হয়ত শেষ হয়ে যাবে। সংক্ষেপে তোমাকে বলব। ভদ্রমহিলা একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন। ঘরের ওয়াল-ক্লকটায় রাত্রি বারোটা ঘোষণা করলে ঢং ঢং করে।
ঠিক মধ্যরাত্রি।
ঘরের মধ্যে ঠাণ্ডা। স্তব্ধতা।
উত্তরের খোলা জানালাপথে শীত-রাত্রির ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে।
জায়গাটার আসল নাম রায়পুর নয়, যদিও আজ প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বৎসর ধরেও জায়গাটাকে রায়পুর বলে সকলে জানে। ভদ্রমহিলা বলতে লাগলেন মৃদু ধীর কণ্ঠে, সুহাস ও সুবিনয় মল্লিকের পিতা রায়বাহাদুর রসময় মল্লিক ছিলেন রায়পুরের পূর্বতন রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিক মহাশয়ের দত্তক পুত্র। শ্রীকণ্ঠ মল্লিক মহাশয়রা তিন ভাই। তাঁদের পূর্ববর্তী সাত পুরুষ ধরে জমিদার রাজা ওঁদের উপাধি। বহু ধন-সম্পত্তির মালিক ওঁরা। শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকের যখন কোনো। ছেলেমেয়ে হল না, তখন বৃদ্ধ বয়সে তিনি রসময়কে দত্তক গ্রহণ করলেন। শ্রীকণ্ঠ মল্লিকদের একমাত্র সহোদরা বোন কাত্যায়নী দেবীর একমাত্র সন্তান হচ্ছেন আমার মৃত স্বামী। আমার নাম সুহাসিনী। আমি আমার স্বামীর মুখেই শুনেছিলাম, তাঁর দাদামশাই শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকের পিতা নাকি মরবার আগে একটা উইল করে গিয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃসেই উইল আইনসিদ্ধ করবার পূর্বেই অকস্মাৎ শ্রীকণ্ঠ মল্লিক একদিন ওঁদের মহাল নৃসিংহ গ্রাম পরিদর্শন করতে গিয়ে অদৃশ্য আততায়ীর হস্তে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন। উইলের ব্যাপারটা অবিশ্যি তাঁর নিহত হওয়ার পর একান্ত আপনার জনদের মধ্যে অল্পবিস্তর জানাজানি হয়।
উইলের মধ্যে অন্যতম সাক্ষী ছিলেন ওঁদেরই জমিদারীর নায়েব শ্রীনিবাস চৌধুরী মহাশয় ও শ্রীকণ্ঠের ছোট ভাই সুধাকণ্ঠ মল্লিক। যদিও শ্রীকণ্ঠ মল্লিক মহাশয়ের নিহত হওয়ার পরও প্রায় বৎসর খানেক পর্যন্ত নায়েবজী বেঁচে ছিলেন, তবু উক্ত উইলের ব্যাপারটা বাইরের কেউই জানতে পারেনি; অনাত্মীয় দু-একজন জানতে পারলেন নায়েবজীর মৃত্যুর দু-দিন আগে। যদিচ নায়েবজী নিজেও জানতেন না যে এ ব্যাপারটা তখন কিছুটা জানাজানি হয়ে গেছে। যা হোক, অনেকদিন থেকেই নায়েবজী হৃদরোগে ভুগছিলেন, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তাঁর অসুখের যখন খুব বাড়াবাড়ি, সেই সময় আমার শাশুড়ী কাত্যায়নী দেবী (সম্পর্কে নায়েবজীর ভ্রাতৃবধূ) নায়েবজীর রোগশয্যার পাশে ছিলেন। মৃত্যুর শিয়রে দাঁড়িয়ে নায়েবজী তাঁর বৌদি কাত্যায়নী দেবীকে ঐ উইলের কথা সর্বপ্রথম বলেন এবং এও বলেন, সেই উইলের প্রধান অন্যতম সাক্ষী স্বয়ং তিনি নিজে, এবং উইলের ব্যাপার সব কিছুই জানেন, তথাপি শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের মৃত্যুর পর সিন্দুকের মধ্যে সে উইলের আর কোনো অস্তিত্বই নাকি পাওয়া যায়নি। উইলের কোনো হদিস পাননি বলেই এবং আইনের দ্বারা উইলটি সিদ্ধ করা হয়ে ওঠেনি বলেই, নেহাৎ নিরুপায় তিনি ও সম্পর্কে এতদিন কোনো উচ্চবাচ্যই করতে পারেননি। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তাঁর স্বগীয় কতার সেই ইচ্ছা, যা কোনোদিনই সফল হতে পারল না, তার আভাস অপূর্ণ খেদোক্তির মধ্য দিয়ে কাত্যায়নী দেবীকে জানিয়ে গেলেন যে কেন, তা তিনিই জানেন।
কাত্যায়নী দেবী সমস্ত শুনে গেলেন নীরবে, এবং ঘুণাক্ষরেও আভাসে বা ইঙ্গিতে প্রকাশ করলেন না যে ঐ ব্যাপার আগে হতেই তিনি কিছুটা জানতেন। ঐ সময় আমার স্বামী সবে ওকালতি পাস করে ওকালতি শুরু করেছেন এবং সুধীন—আমার ছেলের বয়স তখন মাত্র আড়াই বৎসর। আমার শ্বশুরের মৃত্যু তারও বারো বৎসর আগে হয়। নায়েবজীর মৃত্যুর পর মা গৃহে ফিরে এলেন। এবং তারই মাস তিনেক বাদে হঠাৎ একদিন আমার স্বামী ওকালতি ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে রায়পুরের স্টেটের ম্যানেজারের পদ নিয়ে রায়পুরে গেলেন। রসময় মল্লিক তখন জমিদারীর সর্বময় কর্তা। এই পর্যন্ত বলে ভদ্রমহিলা থামলেন।