কিরীটী যেন কতকটা ইচ্ছে করেই সভা ভঙ্গ করে উঠে দাঁড়াল। কাজেই অন্যান্য সকলকেও উঠে দাঁড়াতে হল সেই সঙ্গে।
সত্যিই রাত্রি বড় কম হয়নি। দেওয়াল-ঘড়িটা সগৌরবে ঘোষণা করলে রাত্রি দশটা ঢং ঢং করে।
***
আহারাদির পর সকেলই বিদায় নিয়েছেন।
কিরীটী তার শয়নকক্ষের পশ্চিমদিকের ভোলা জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছে। কৃষ্ণা শুয়ে বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে, জানালাপথে দেখা যায়, রাত্রির একটুকরো আকাশ; কয়েকটি মাত্র উজ্জ্বল নক্ষত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে।…সুদূরের কালো ভীরু চাউনির মত মৃদু কম্পিত। খোলা জানালাপথে শীতরাত্রির ঝিরঝিরে হাওয়া আসছে হিমকণাবাহী।
কিরীটী ভাবছিল কত না হত্যা-ব্যাপার নিয়েই সে এ জীবনে ঘাঁটাঘাঁটি করলো! কত বৈচিত্র্যই যে হত্যা-রহস্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ভাবতেও আশ্চর্য লাগে। কিরীটী মধ্যে মধ্যে ভাবে এমন যদি হত হত্যাকারী অসাধারণ বুদ্ধিমান এবং বুদ্ধি ও বিবেচনার দ্বারা হত্যার। পূর্বেই চারিদিক বাঁচিয়ে সমস্ত পরিকল্পনামত একান্ত সুষ্ঠুভাবে হত্যা করতে পারত, তবে কার। সাধ্য তাকে ধরে! কিন্তু এরকম কখনও আজ পর্যন্ত সে হতে দেখল না। সামান্য একটু গলদ, সামান্য একটু ভুল। হত্যাকারীর সমগ্র পরিকল্পনা সহসা বানচাল হয়ে যায়। নিজের ভুলে নিজেই বিশ্রীভাবে জট পাকিয়ে ফেলে। এমনিই নিয়তির মার!
বাবু!
কিরীটী চমকে ফিরে তাকায়। দরজায় দাঁড়িয়ে ভৃত্য জংলী।
কি রে জংলী?
একজন ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
এত রাত্রে কে আবার ভদ্রমহিলা দেখা করতে এলেন? বসতে দিয়েছিস তো?
হুঁ, বাইরের ঘরে বসিয়েছি। বললেন আপনার সঙ্গে নাকি বিশেষ কি দরকার, এখুনি দেখা হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
আচ্ছা তুই যা, আমি আসছি।
কিরীটী আদৌ আশ্চর্য হয় না, কারণ এরকম অসময়ে বহুবার বহু লোকই তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। এবং অনেক সময় অনেক ভদ্রমহিলাও দেখা করতে এসেছেন।
কিরীটী গরম ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে একতলায় নামবার সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হল।
সোজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই আগন্তুক ভদ্রমহিলা সোফা হতে উঠে দাঁড়ালেন।
ঘরের উজ্জ্বলবৈদ্যুতিক আলোয় কিরীটী দেখল, ভদ্রমহিলা বেশবর্ষীয়সী। বয়স পঁয়তাল্লিশের ঊর্দ্ধে নিশ্চয়ই। পরিধানে সাধারণ মিলের একখানা সাদা থানকাপড়। গায়ে একটা ছাই রঙের পুরনো দামী শাল জড়ানো। মাথার ওপরে ঈষৎ ঘোমটা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। মুখে। বয়সের বলিরেখা পড়েছে সুস্পষ্টভাবে। একদা যে ভদ্রমহিলা বয়সের সময়ে অতীব সুশ্রী ছিলেন, প্রথম দৃষ্টিতেই তা এখনও বেশ বোঝা যায়, বিগত সৌন্দর্যের এখনও অনেকখানিই। যেন সমগ্র দেহ ও বিশেষ করে মুখখানি জুড়ে বিরাজ করছে। লম্বাটে বোগা চেহারা। চোখে শান্ত স্থির দৃষ্টি।
বসুন মা, আপনি উঠলেন কেন? কিরীটী ভদ্রমহিলাকে সম্বোধন করে।
তোমারই নাম কিরীটী রায়? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করেন।
হ্যাঁ, বসুন। কিরীটী এগিয়ে এসে একখানা সোফা অধিকার করে সামনাসামনি বসল।
ভদ্রমহিলাও আবার উপবেশন করলেন। হাতের আঙুলগুলি পরস্পর জড়িয়ে, হাত দুটিকোলের উপর রাখলেন, এই অসময়ে তোমাকে বিরক্ত করবার জন্য সত্যিই বড় লজ্জা বোধ করছি বাবা। তারপর একটু থেমে, আবার ধীর শান্তস্বরে বললেন, মা বলে যখন তুমি আমায় সম্বোধন করলে প্রথমেই, নিজের সন্তানের মতই তোমাকে আমি তুমি বলে সম্বোধন করছি। তাছাড়া তুমি তো আমার সন্তানেরই মত।
কিরীটী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল; কেন যেন মনে হচ্ছিল মুখখানি খুবই চেনা। কবে কোথায় ঠিক এমন একটি মুখ না দেখলেও অনেকটা এমনি একখানি মুখের আদল দেখেছে ও।
অস্পষ্ট একটা ছায়ার মতই মনের কোণে ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠে আবার যেন মিলিয়ে যাচ্ছে অস্পষ্ট হয়ে।
কিরীটীকে সামনে বসে একদৃষ্টে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করলেন, আমার মুখের দিকে অমন করে তাকিয়ে কি দেখছ?
কিছু না মা! ভাবছিলাম আপনার মুখখানি যেন বড় চেনা-চেনা লাগছে, কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। এবারে মনে পড়েছে। রায়পুরের আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরী কি–
ঠিক ধরেছ, আমি—আমি তারই হতভাগিনী মা। কিন্তু আমার পরিচয় তো এখনও তোমায় আমি দিইনি বাবা! কেমন করে বুঝলে?
না, দেননি, নিম্নস্বরে কিরীটী মৃদু হেসে বললে, কিন্তু আপনার ছেলের মুখখানি যেন আপনারই মুখের হুবহু একখানি প্রতিচ্ছবি। আপনি তাহলে রায়পুরের মামলা সংক্রান্ত কোনো ব্যাপার নিয়েই আমার কাছে এসেছেন?
হ্যাঁ। রায়পুরের ছোট কুমার সুহাসের মৃত্যুর ব্যাপারটা তো সবই বোধ হয় তোমরা জান?
সব নয়, তবে কিছুটা কিছুটা জানি। মামলার সময় সংবাদপত্র পড়ে যতটুকু জেনেছি।
রায়পুরের মল্লিক-বাড়ির অনেক কথাই তোমরা জান না। এবং যাঁরা বিচারের নামে দীর্ঘদিন ধরে একটা নিছক প্রহসন করে আমার একমাত্র নির্দোষ ছেলেকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ দিলেন, তাঁরাও জানতেন না বা জানবার জন্য এতটুকু চেষ্টাও করেননি। অথচ বিচার হয়ে গেল, এবং দোষী সাব্যস্ত করে দ্বীপান্তরের আদেশও হয়ে গেল।
কিন্তু মা, আপনার ছেলের বিরুদ্ধে প্রমাণগুলিও তো আইনের চোখে খুবই সাংঘাতিক এবং বেশ জোরালো। তাছাড়া আইনের বিচারে তার দোষও প্রমাণিত হয়ে গেছে।