হ্যাঁ।
এর পর সাক্ষী দেওয়ার জন্য ডাঃ অমর ঘোষ ও কর্ণেল কৃষ্ণমেননের ডাক পড়ে আদালতে।
প্রথমে ডাঃ ঘোষকে প্রশ্ন করা হয়।
রায়বাহাদুর অনিমেষ হলদার জেরা করেন, ডাঃ ঘোষ, আপনি ডাঃ মুখার্জীর অধীনে ট্রপিক্যাল ইন্সটিউটে রিসার্চ করেন?
হ্যাঁ।
কত দিন আগে?
আজ প্রায় দু বৎসর হবে।
আপনি গত ডিসেম্বরের প্রথম দিকে বম্বেতে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
বম্বেতে আপনি প্লেগ রিসার্চ ইনস্টিটিউটে কাজ করবার জন্য ডাঃ মুখার্জীর কোনো পরিচয়পত্র নিয়ে গিয়েছিলেন?
না।
তা যদি না হয়, তাহলে কি করে আপনি বম্বে প্লেগ রিসার্চ ইনস্টিটিউটে প্রবেশঅধিকার পেলেন? আমরা যতদূর জানি, একমাত্র গভর্ণমেন্টের স্পেশাল পারমিশন ব্যাতিরেকে কারও সেখানে প্রবেশ নিষেধ।
কর্ণেল কৃষ্ণমেননের সঙ্গে দেখা করে আমি তাঁর অনুমতি চেয়ে নিয়েছিলাম দিনকয়েকের জন্য।
কত দিন কাজ করেছিলেন?
দিন কুড়ি মত হবে।
কর্ণেল কৃষ্ণমেননের সঙ্গে এই ঘটনার পূর্বে আপনার কোনো পরিচয় ছিল কি?
হ্যাঁ, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে মেডিক্যাল কনফারেন্সে কর্ণেল কৃষ্ণমেনন কলকাতায় এসেছিলেন, সেই সময় তাঁর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবার সৌভাগ্য হয়েছিল।
এ কথা কি ঠিক কর্ণেল কৃষ্ণমেনন?
হ্যাঁ। কৃষ্ণমেনন জবাব দেন।
আপনি ঠিক বলছেন, আপনার কাছে ডাঃ ঘোষ কোনো লেটার অফ ইনট্রোডাকশান পেশ করেননি?
না।
ডাঃ ঘোষ, ৩১শে মে শিয়ালদহ স্টেশনে সুহাস মল্লিক অসুস্থ হবার দিন সাতেক আগে হঠাৎ আপনি বম্বে হতে কলকাতায় ফিরে আসেন—এ কথা কি সত্য?
হ্যাঁ।
হঠাৎ কুড়িদিন কাজ করেই আবার আপনি ফিরে এলেন যে?
আমার ছুটি ফুরিয়ে গিয়েছিল।
কলকাতায় ফেরবার পর আপনাকে প্রায়ই ঘন ঘন দুপুরের দিকে ডাঃ মুখার্জীর কলকাতার বাসভবনে যাতায়াত করতে দেখা যেত কয়েকদিন যাবৎ, এ কথা কি সত্যি?
হ্যাঁ, আমি প্রায়ই তাঁর কাছে যেতাম, আমি একটা থিসিস সাবমিট করব, সেই সম্পর্কেই আলোচনা করবার জন্য ডাঃ মুখার্জীর ওখানে আমার যাওয়ার প্রয়োজন হত।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল, সুব্রত সেদিনকার মত উঠে পড়ল। সারাটা দিন আদালতের কাগজপত্র ঘেঁটে মাথাটা যেন কেমন টিপ টিপ করছে।
***
সেই দিন সন্ধ্যায় আবার কিরীটী বলছিল, দেখা যাচ্ছে সমগ্র হত্যাকাণ্ডটাই আগাগোড়া একটা চমৎকার পূর্বপরিকল্পিত ব্যাপার। কিন্তু আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরী যেন একটা পরিপূর্ণ মিস্ট্রি, তাঁর প্রত্যেকটি statement থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, কাউকে তিনি যেন সযত্নে shield করবার চেষ্টা করছেন আগাগোড়া।
তোর তাই মনে হয়! সুব্রত প্রশ্ন করে।
তাই।
কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রসিডিংস থেকে যতদুর জানা গেছে, তাতে করে ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে বাঁচাতে পারে এমন কেউই নেই। ভদ্রলোক একেবারে গলা-জলে।
আমাদের এখন তাকে সেই গলা-জল থেকে টেনে তোলবার চেষ্টা করতে হবে।
এখন কি তুই মনে করিস কিরীটী, ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে বাঁচাতে পারবি?
চেষ্টা করতে দোষ কি! হয়তো গলা-জলের মধ্যেও একটা ভাসমান কাষ্ঠখণ্ড দেখা দেবে! কিন্তু সে কথা যাক, আপাতত আমাকে কাগজপত্র ছেড়ে কিছুদিন ঘোরাফেরা করতে হবে।
১.০৯ হারাধন ও জগন্নাথ
সুব্রত বিস্মিতভাবে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
হ্যাঁ শোন, কালই তোকে রায়পুর যেতে হবে একবার।
রায়পুর!
হ্যাঁ।
শুনেছি সেখানকার আবহাওয়াও খুব ভাল, সেখানে গিয়ে দুটো কাজ তোকে করতে হবে। প্রথমত রায়পুরের রাজবাড়ীর ওপর তোকে সর্বদা তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। রাজা সুবিনয় মল্লিক মহাশয় এখন সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে রাজধানীতে বিরাজ করছেন। তাঁর সঙ্গে যেমন করেইহোকতোকে ঘনিষ্ঠ হতে হবে,—এইহচ্ছেতোর প্রথম কাজ। দ্বিতীয়ত—আমাদের সদর নায়েবজী বা স্টেটের ম্যানেজার বা মল্লিক মশাইয়ের প্রাইভেট সেক্রেটারী সতীনাথ লাহিড়ীর সঙ্গে ও তাদের পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ অমিয় সোমের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। রহস্যের মূল জানবি ঐখানেই লুকিয়ে আছে। হত্যার বীজ ওখানেই প্রথম রোপিত হয়েছিল বলেই আমার স্থির বিশ্বাস।
কিন্তু এতগুলো অঘটন কি করে যে নির্বিবাদে সংঘটিত হতে পারে সেটাই আমি ভাবছি কিরীটী! সুব্রত হাসতে হাসতে বলে।
অত না ভাবলেও চলবে। এই দেখ আজকের দৈনিক ভারত জ্যোতি কাগজখানা; দিন পাঁচেক থেকে এই কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিচ্ছেযে রায়পুর স্টেটের জন্য একজন সুপারভাইজার চান রাজাবাহাদুর।
সুব্রত তখুনি আগাগোড়া বিজ্ঞাপনটা পড়ে ফেললে। কিন্তু জমিদারী কাজে সুদক্ষ, অভিজ্ঞ, বিশিষ্ট লোকের পরিচয়পত্র—এই যে তিনটি প্রচণ্ড বোমা এর মধ্যে লুকিয়ে আছে এগুলো কোথায় মিলবে শুনি?
ডাঃ সান্যালকে দিয়ে ডাঃ কালীপদ মুখার্জীর কাছ থেকে গতকালই তোর অর্থাৎ শ্রীযুক্ত কল্যাণ রায়, এম. এ. বি. এল.-এর নামে একখানা পরিচয়পত্র আনিয়ে রাখা হয়েছে। আগামী কালের জন্য ট্রেন সিটও রিজার্ভ হয়ে গেছে। এখন শুধু কল্যাণবাবুর গমনের প্রত্যাশাটুকু!
মানে, তুই সব আগে থেকেই রেডি করে রেখেছিস বল?
হ্যাঁ।
But this is foregery–
নান্যঃ পন্থা!
***
ভোরবেলা, সবে পূর্বাকাশে ঊষার রক্তিম রাগ দেখা দিয়েছে, সুব্রত রায়পুর স্টেশনে এসে গাড়ি থেকে নামল। রায়পুর স্টেশনটি বেশ মাঝারি গোছের; গাড়ি থেকে যাত্রীও নেহাৎ কম নামেনি।
স্টেশন মাস্টারটি বাঙালী—প্রাণধন মিত্র। বয়সে পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। সমস্ত মাথাটি জুড়ে সুবিস্তীর্ণ চকে মসৃণ একখানি টাক। স্থানীয় ছেলেছোকরারা আড়ালে টেকো মিত্তির বলে ডাকে শোনা যায়। নধর হৃষ্টপুষ্ট গোলগাল চেহারা।