সুব্রত প্রশ্ন করে, কেন? কোথায় ভুল করছি?
কিরীটী বলে, এই ধরনের হত্যা-ব্যাপারের যত কিছু রহস্য সব হত্যার গোড়াতেই থাকে। হত্যা সংঘটিত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সকল রহস্যের ওপরে যবনিকাপাত। কোনো একটা বিশেষ ব্যাপারে, কতকগুলো বিশেষ লোক, কোনো একটা বিশেষ কাজ করেছে। এই যে কতকগুলো লোকের একটা বিশেষ সংস্থান, একটা বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে, একটা বিশেষ সময়ে, এইখানেই আমাদের যত কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে। কাজে কাজেই ঐ খুন বা হত্যার ব্যাপারের রহস্য উদঘাটন করতে হলে আমাদের হত্যা-ব্যাপারের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যাবতীয় সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার করে দেখতে হবে। সমগ্র রহস্যটুকুর মধ্যে হত্যাটাই তো শেষ পরিচ্ছেদ বা সমাপ্তি মাত্র।
কিরীটী বলে চলে, তোমরা সকলে এবং অনুসন্ধানকারীরাও ঐ শেষ পরিচ্ছেদ থেকেই বার বার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করছ। তাই তোমরা সত্যের শেষধাপে কোনমতে পৌঁছাতে পারছ না। শুরু কর সেই প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে এবং তাহলেই আসল সত্যের মূলে আসতে পারবে।
কিরীটী একটু থেমে আবার বলতে লাগল, ধর আমাদের আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরীর ব্যাপারটাই। সুহাস মল্লিকের হত্যার সময়টিও ঠিক সে অকুস্থানে অর্থাৎ কলকাতায় ছিল না অর্থাৎ মৃত্যুর সময়টায় সে কয়েকদিনের জন্য বেনারসে চলে গিয়েছিল এবং মৃত্যুর দিন পাঁচেক বাদেই আবার সে ফিরে আসে। মাঝখানে মাত্র পাঁচ-সাতটা দিন, এতেই সে জড়িয়ে · পড়ল হত্যাপরাধের ব্যাপারে। কেননা প্রথমত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে শেষবার সুহাস মল্লিক যখন রায়পুরে যান, মামলায় জানা যায় শিয়ালদহ স্টেশনে তখুনি নাকি ছোট কুমারের দেহে প্লেগ ব্যাসিলাই ইজেশন করা হয় এবং সুধীন চৌধুরী তখন সেই দলের মধ্যে ছিলেন। দ্বিতীয়ত সুধীন চৌধুরী একজন ডাক্তার। ডাঃ চৌধুরীর প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ তাঁর ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সটা হঠাৎ গত মাস দুয়ের মধ্যে বিশেষরকম ভাবে কেঁপে উঠেছিল, যেটা তাঁর দশ বছরের ইনকামের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো গেল না, এবং তিনিও নিজে তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে একপ্রকার রাজীই হলেন না আদালতে বিচারের সময়। তাহলেই ভেবে দেখ, ব্যাপার যাই হোক না কেন, স্থূল দৃষ্টিতে বিচার করে দেখতে গেলে ডাঃ সুধীন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সত্যিই কি বেশ জটিল নয়?
ঘরের মধ্যে উপবিষ্ট সব কটি প্রাণীই যেন রুদ্ধ নিশ্বাসে কিরীটীর কথাগুলো শুনছিল। কারও মুখে একটি টু শব্দ পর্যন্ত নেই। জমাট স্তব্ধতা। ঠিক এভাবে তো ওদের মধ্যে কেউই বিচার বা বিশ্লেষণ করে দেখেনি মামলাটা সত্যিই।
তোমরা হয়ত বলবে, কিরীটী আবার শুরু করে, মামলার that black man with the umbrella, সেই ছাতাওয়ালা কালো লোকটি, যার সব কিছু শেষ পর্যন্ত মিস্ট্রিই রয়ে গেল, আগাগোড়া মামলাটায়, সেই যে আসল কালপ্রিট নয় তাই বা কি করে বলা যায়?
সুব্রত প্রশ্ন করে, তুমি কি তাই মনে কর?
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, মনে আমি অনেক কিছু করি, আবার করিও না।
সুব্রত বলে, কিন্তু আমারও মনে হয়, এ ব্যাপারে he was only an instrument, তাকে সামান্য একটা instrument হিসাবেই এ হত্যার ব্যাপারে কাজে লাগানো হয়েছিল। আসলে নাটকের সেই অপরিচিত কালো লোকটি (?) একটা side character মাত্র। তার কোনো importance-ই নেই এই হত্যা-মামলায়।
প্রত্যুত্তরে কিরীটী বলে, হয়তো তোমার ধারণা বা অনুমান মিথ্যা নাও হতে পারে সুব্রত, কিন্তু তবু সেই অজ্ঞাত ছাতাওয়ালার আগাগোড়া movementটা যদি trace করা যেত, তবে আসল হত্যাকারীর একটা কিনারা করা যেত কিনা তাই বা কে বলতে পারে? Side character হলেও un-important তো নয়?
মৃদুস্বরে সুব্রত বলে, আমার কিন্তু মনে হয় তা সম্ভব হত না।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, হয়ত যেত না—তবু কথাটা ভাববার কারণ, প্রথমত এই মামলার আসল হত্যাকারীর সঙ্গে ঐ বিশেষ লোকটির কোনো যোগাযোগ ছিল বা ছিল না—কিংবা হত্যাকারী অন্য দিক দিয়ে বিচার করলে সেই লোকটির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রেখেছে বা রাখেনি—এবং নিজে আড়ালে থেকে লোকটিকে দিয়ে কৌশলে কাজটুকু করিয়ে নিয়েছে সব কিছুই ভেবে দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত সেই ছত্রধারী লোকটি আসল ব্যাপারটা–তাকে দিয়ে যে অন্য একটি লোকের দেহে প্লেগের বিষ সংক্রামিত করা হচ্ছে, সেটা সে বুঝতে শেষ পর্যন্ত পেরেছিল কিনা—আমি স্থিরনিশ্চিত যে সেই লোকটি হাতে ছাতাটা আসবার আধ ঘণ্টা আগে পর্যন্তও সেই কালোলোকটি ছাতার কোনো অস্তিত্বও। জানতে পেরেছে কিনা সন্দেহ। এবং সেই ছাতাটাই যে ছিল সকল রহস্যের মূল সে কথাটা ভুললে চলবে না।
একটা সামান্য তুচ্ছ ছাতার মধ্যে এমন কি মিস্ট্রি থাকতে পারে, তা তো বুঝে উঠতে পারছি না, বলল মিঃ তালুকদার।
ছাতাটা যে তুচ্ছ তা আপনাকে বললে কে মিঃ তালুকদার? আমার যতদূর মনে হয়, এই হত্যা-রহস্যের মূল সূত্রই, সেই তুচ্ছ ছাতাটার মধ্যেই আমাদের সকলের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে হয়ত লুকিয়ে রয়ে গেছে। The brain behind it—তার আমি প্রশংসা না করে থাকতে পারি না। হত্যা-রহস্যের মজাই ঐ! সামান্যতম ঘটনা বা বস্তুর সঙ্গে যে কত সময়। কত মূল্যবান সূত্র জট পাকিয়ে থাকে, আমাদের দৃষ্টিশক্তি বা বিচার-বুদ্ধিকে ফাঁকি দিয়ে বা আমাদের দৃষ্টিশক্তির বিচার-বিশ্লেষণের অভাবে যা হয়ত আমরা কত সময় লক্ষ্যই করি না। রায়পুরের হত্যা-রহস্যের মধ্যেও তেমনি মূল্যবান একটি সূত্র ঐ তুচ্ছ ছাতাটা, যা তদন্তের সময় বা আদালতে বিচারের সময় কেউই আবশ্যকীয় বলে এতটুকু নজর দেবার প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু কথার তর্কে-বিতর্কে রাত্রি অনেক হয়েছে। এবারে এস, আজকের মত সভা ভঙ্গ করা যাক। নাসারন্ধ্রে সুমধুর খিচুড়ির ঘ্রাণ আসছে। এই শীতের রাত্রে গরম গরম খিচুড়ি সহযোগে ফুলকপির চপ ও আলুর ঝুরিভাজা নেহাৎ মন্দ লাগবে না, কি বল হে?