কিন্তু মেডিকেল কলেজে একই শ্রেণীর ছাত্রদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় থাকাটাই বেশী সম্ভপর নয় কি?
সুব্রত পড়ছিল আর নোট করে নিচ্ছিল বিশেষ বিশেষ জায়গায়, ইতিমধ্যে কখন বেলা বারোটা বেজে গেছে ওর খেয়ালই নেই। জাস্টিস্ মৈত্র এসে ঘরে প্রবেশ করলেন আদালতে যাবার বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে, কি, পরশমণির সন্ধান পেলেন সুব্রতবাবু?
সুব্রত মৃদু হাস্যসহকারে উঠে দাঁড়ায়, আজ্ঞে কিছু নুড়ি কুড়িয়েছি, এখনও সব দেখা হয়ে ওঠেনি।
তবে এখানেই আহার-পর্বটা সমাধা করুন না?
আজ্ঞে না, আজ আমি এখন যাই, সে এখন না হয় আর একদিন হবে। আপনার যদি আপত্তি না থাকে, কাল-পরশু দুদিন সকালে একবার করে আসতে পারি কি?
বিলক্ষণ। একবার ছেড়ে যতবার খুশি, আপনার জন্য দ্বার খোলাই রইল। রহস্যভেদীর ব্যাপার-স্যাপার দেখে আমার মনেও কেমন একটা কৌতূহল জেগে উঠছে। আপনি নিশ্চয়ই আসবেন। রহস্যভেদীকেও একটিবার আসতে বলবেন না!
১.০৭ জবানবন্দি জের
সন্ধ্যার দিকে সুব্রত ও কিরীটীর মধ্যে আলোচনা চলছিল।
কিরীটী বলছিল, রায়পুরের হত্যা-মামলার প্রসিডিংসের ভিতর থেকে যতটুকু তুই পড়েছিস ও যে যে পয়েন্টগুলো নোট করে এনেছিস, সেগুলো আগাগোড়া বেশ ভাল করেই পড়ে দেখলাম, সমস্ত ব্যাপারটা বিবেচনা করে দেখলে কয়েকটা অত্যন্ত স্থূল অসংগতি আমাদের চোখে পড়ে।
সুব্রত প্রশ্ন করে, কি রকম?
কিরীটী বলে, প্রথমত এই ধর—১নং… তারিখের জবানবন্দি, যে সময় আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরী প্রথমে অস্বীকার করছে আদালতে জেরার সময়, গত ৩১শে মে স্টেশনে তার হাতে বাক্সের কত কিছু ছিল না বলে। অথচ আবার জেরার মুখে দিন দুই পরে সতীনাথবাবুর জবানবন্দিতে প্রকাশ পাচ্ছে, সুধীনের হাতে নাকি একটা কালো রংয়ের মরোক্কো-বাঁধাই ছোট্ট কেস ছিল এবং বিপক্ষের উকিলের জেরায় সে কথা সেদিন স্বীকারও করে নিল যে তার হাতে একটা কেস ছিল। এখন কথা হচ্ছে,কেন আসামী সুধীন চৌধুরী প্রথম দিনের জেরার সময় ঐ কথাটা অস্বীকার করলে? কি এমন তার কারণ থাকতে পারে? স্বাভাবিক বুদ্ধিমত বিচার করতে গেলে, তার এই অস্বীকারের মধ্যে দুটো কারণ থাকতে পারে, ১নং, হয় আসামীর সেকথা জবানবন্দি সময় আদপে সত্যই মনে হয়নি এবং ব্যাপারটার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু থাকতে পারে বলে সে ভাবেওনি। ২নং, হয়ত কোনো বিশেষ কারণেই প্রথম হতে আসামী সুধীন চৌধুরী ব্যাপারটা চেপে যাবার প্রয়াস পেয়েছে। এখন যদি ব্যাপারটার একটা আপাত মীমাংসা হিসাবে প্রথম কারণটা ছেড়ে দিয়ে আমরা দ্বিতীয় কারণটাই ধরে নিই, তাহলে আসামীর বিরুদ্ধে সেটা যাচ্ছে এবং তার সত্যাসত্যের একটা বিশেষ মীমাংসার প্রয়োজনও হচ্ছে আমাদের দিক হতে এখন—সত্যি কিনা?
সুব্রত মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়। কিরীটী আবার তখন বলতে শুরু করে, তাহলে দাঁড়াচ্ছে, মামলার প্রসিডিংসের মধ্যে ১নং উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট:ছোট মরোক্কো বাঁধাই কেসটা, ২নং পয়েন্ট: এই মরোক্কো কেসটা সম্পর্কে প্রথমে সুধীনের অস্বীকার ও পরে স্বীকৃতি।
সুব্রত প্রশ্ন করে, আচ্ছা কিরীটী,ডাঃ মিত্রের জবানবন্দী সম্পর্কে তোর কি মনে হয়?
ডাঃ মিত্র সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলেছেন বলেই আমার ধারণা এবং আগাগোড়াই বিপক্ষের কারসাজি। সুধীন চৌধুরীকে ডাঃ মিত্র শুধু যে চিনতেন তাই নয়, বেশ ভাল ভাবেই চিনতেন। কিরীটী মৃদু অথচ কঠিন স্বরে জবাব দেয়।
***
পরের দিন জাস্টিস্ মৈত্রের বাড়িতে।
সুব্রত ঠিক আগের দিনের মতই গতকালের দেখা ফাইলের পরবর্তী অংশটুকু দেখছিল পড়ে।
আদালতে জেরা চলছিল আবারও সেদিন আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরীর ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স সম্পর্কেই। সেই পুরাতন প্রশ্নের জের। প্রশ্ন করছিলেন রায়বাহাদুর অনিমেষ হালদার, সুধীনের পক্ষের উকিল।
ধর্মতলার জেনারেল অর্ডার সাপ্লায়ার বোস এ্যাণ্ড চৌধুরী কোম্পানী সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন, ডাঃ চৌধুরী?
জানি, কারণ ওয়াকিং পার্টনার আমিই ছিলাম বোস এ্যাণ্ড চৌধুরী কোম্পানীর।
আপনাদের কোম্পানী কি ধরনের অর্ডার সাপ্লাই করত সাধারণত?
আমরা বড় বড় ফার্মাসিউটিস্টদের কাছ থেকে উচ্চহারের কমিশনে রীটেলে ওষুধ ও . পারফিউমারী কিনে সেই সব কলকাতার বিভিন্ন ঔষধ প্রতিষ্ঠানে সাপ্লাই করতাম।
উক্ত কোম্পানীতে আপনার লভ্যাংশের কি টার্মস্ ছিল?
নীট লাভের একের-তিন অংশ আমি পাব, এই চুক্তি ছিল।
কত দিন ধরে ঐ কোম্পানীর সঙ্গে আপনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন?
তা বছর দেড়েক হবে।
আপনাদের কোম্পানীর কাগজপত্র চেক করে দেখেছি, মাসে হাজার দুহাজার টাকার মত আপনাদের কোম্পানীর নিট লাভ থাকত, এবং এও দেখেছি তিন মাস অন্তর আপনাদের হিসাবনিকাশ হত। তাই যদি হয়ে থাকে তবে অন্তত পাঁচবার লাভের অংশ আপনি পেয়েছেন, কেমন কিনা?
পেয়েছি। দুবার মাত্র পেয়েছি।
দুবারে কত পেয়েছেন?
হাজার সাতেক হবে।
সে টাকা আপনি কি করেছিলেন?
ব্যাঙ্কেই জমা রেখেছিলাম।
এমন সময় সন্তোষবাবু প্রশ্ন করলেন, ডাঃ চৌধুরী, আপনার ব্যাঙ্কের জমাখরচ থেকে জানা যায় ২৭শে এপ্রিল নগদ পাঁচ হাজার টাকা ও ৫ই মে আবার নগদ পাঁচ হাজার টাকা। আপনি আপনার অ্যাকাউন্টে ব্যাঙ্কে জমা দিয়েছেন, অত টাকা আপনি একসঙ্গে কোথায় নগদ পেলেন ঐ অল্প সময়ের মধ্যে বলবেন কি?