বসুন। জাস্টিস্ মৈত্র সুব্রতকে একখানা চেয়ার নির্দেশ করেন।
সুব্রত উপবেশন করল।
জাস্টিস মৈত্র কাঁচের শো-কেস খুলে তার ভিতর থেকে গোটা-দুই মোটা মোটা ফাইল টেনে বের করে সুব্রতর সামনে টেবিলের ওপরে এনে রাখলেন।
সুব্রত দেখলে, ওপরের ফাইলটার ওপরে ইংরাজীতে টাইপ করা লেখা—Roypur Murder Case No.1. File.
এই নিন নথিপত্র। দেখুন কি দেখতে চান। কিরীটীর বন্ধু যখন আপনি, চায়ে নিশ্চয়ই আপনার অরুচি হবে না, কি বলেন?
সুব্রত হাসতে হাসতে জবাব দেয়, না।
তবে বেশ আপনি এখানে বসে বসে আপনার যা-যা প্রয়োজন দেখুন, আমার আবার একটা জরুরী কেসের রায় লিখে আজই শেষ করে নিয়ে যেতে হবে। আমি আপনার চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। রহস্যভেদীর বন্ধুত্বের সাটিফিকেট নিয়ে আপনি এ বাড়িতে এসেছেন, কোনো সংকোচ বা দ্বিধার আপনার প্রয়োজন নেই। নিজের বাড়ি বলেই মনে করবেন। টেবিলের ওপরে ঐ কলিং বেল আছে, দরজার বাইরেই আমার ভোলানাথ আছে, প্রয়োজন হলে চেয়ে নিতে সংকোচ করবেন না। আর যদি কোথাও বোঝবার প্রয়োজন হয়, ভোলানাথকে দিয়ে পাশের ঘরে আমাকে একটা সংবাদ পাঠাবেন।
ধন্যবাদ। আপনাকে অত ব্যস্ত হতে হবে না জাস্টিস্ মৈত্র। আপনি আপনার কাজ করুন গে।
বেশ বেশ।
জাস্টিস্ মৈত্র হাসতে হাসতে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
***
মামলাটা আগাগোড়া সত্যিই অত্যন্ত জটিল ও ইন্টারেস্টিং।
পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ফাইলের মাঝামাঝি জায়গায় উপস্থিত হয়ে সুব্রত দেখলে, আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরীর জবানবন্দি শুরু হয়েছে।
সুধীনের পক্ষে নামকরা উকিল রায়বাহাদুর অনিমেষ হালদার।
রাজবাড়ির পক্ষে উকিল সন্তোষ ঘোষাল। তিনিও কম যান না।
সন্তোষ ঘোষাল প্রশ্ন করছেন আসামীকে, মৃত সুহাস মল্লিকের সঙ্গে আপনার কতদিনকার আলাপ-পরিচয় সুধীনবাবু?
তা প্রায় পাঁচ বছর হবে।
আপনি আপনার জবানবন্দিতে এক জায়গায় বলেছেন, সুহাস মল্লিককে সর্বপ্রথম একদিন আপনাদের কলেজের আউটডোর পেসে ডিপার্টমেন্টে পেসে হিসাবে দেখেন!
হ্যাঁ।
তার আগে সুহাস মল্লিককে কোনো দিনও আপনি দেখেন নি বা পরিচয়ও ছিল না—এই তো বলতে চান?
হ্যাঁ।
আর একবার ভাল করে ভেবে দেখুন তো! ছোটবেলায় কোনো সময় ওই ঘটনার পূর্বে দেখা হতেও তো পারে! ছোটবেলার ঘটনা বলেই হয়তো আপনার মনে পড়ছে না?
না–দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না, কারণ সুহাসের সঙ্গে আটউডোর পেসে ডিপার্টমেন্টে দেখা হওয়ার পূর্বে তাদের পরিবারের সঙ্গে আমার কোনো সংবই ছিল না।
আচ্ছা একটা কথা, আপনি নিশ্চয়ই জানতেন রায়পুরের ছোট কুমারের নামই সুহাস মল্লিক?
হ্যাঁ, শুনেছিলাম।
কোনো দিন আপনার কোনো কৌতূহল হয়নি, রায়পুর রাজবাড়ি সম্পর্কে কোনো কিছু জানবার?
না।
এখানে সুধীনের পক্ষের উকিল অনিমেষ হালদার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন মি লর্ড! এ ধরনের প্রশ্ন এ মামলায় সম্পূর্ণ অবান্তর। আমি প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হচ্ছি।
জাস্টিস্ মৈত্র বললেন, objection sustained। মিঃ ঘোষাল, অন্য প্রশ্ন থাকে তো করুন।
সুব্রত আবার নথির পাতা ওল্টাতে থাকে।
আবার আর এক জায়গায় সন্তোষ ঘোষাল প্রশ্ন করছেন সুধীন চৌধুরীকে, দেখুন মৃত ছোটকুমার গত ৩১শে মে যখন শেষবার রায়পুরে যান, আপনি সেদিন সকাল আটটা থেকে রাত্রি সাড়ে আটটায় কুমারকে ট্রেনে তুলে দেওয়া পর্যন্ত কুমারের সঙ্গেই ছিলেন, তাই নয় কি?
সুধীন বলে, না, আগাগোড়া ছিলাম না। মাঝখানে বেলা সাড়ে দশটা থেকে বেলা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত ছোটকুমারের গাড়ি নিয়ে শিয়ালদহে আমার দুটি পেসেন্টকে দেখতে গিয়েছিলাম।
বাকী সময়টা—মানে মাঝখানের ওই দুঘণ্টা বাদ দিয়ে, কুমারের সঙ্গে সঙ্গেই আপনি ছিলেন, কেমন? এই তো বলতে চান?
হ্যাঁ।
আপনি রোগী দেখতে যাবার আগে ও রোগী দেখে ফিরে আসবার পর আপনার ডাক্তারী ওষুধ ও যন্ত্রপাতির ব্যাগটা কোথায় ছিল?
ছোট অ্যাটাচি কেষ্টা কেবল আমার সঙ্গে সঙ্গেই ছিল।
স্টেশনেও সেটা নিয়েই গিয়েছিলেন?
না, গাড়ির মধ্যে রেখে গিয়েছিলাম।
স্টেশনে পৌঁছনোর সময় থেকে কুমারকে গাড়িতে তুলে দেওয়া পর্যন্ত যে সময়টা, সেই সময়ে আপনার হাতে আর কিছু ছিল?
না।
বেশ। এবারে বলুন, আপনি পাস করবার পর প্র্যাকটিস করতে শুরু করেছেন কত দিন?
তা বছর দুই হবে।
আচ্ছা আমহার্স্ট স্ট্রীটে যে আপনার ডিসপেনসারী, তার গোড়াপত্তনের মানে মূলধন, আপনি কোথায় পেয়েছিলেন?
ঐ সময় রায়বাহাদুর অনিমেষ হালদার প্রতিবাদ করছেন, মি লর্ড, এ ধরনের প্রশ্নও সম্পূর্ণ অবান্তর। এ ধরণের প্রশ্নের জবাব দিতে আমার মক্কেল মোটেই প্রস্তুত নয়। আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
ঘোষাল জবাব দিচ্ছেন, আমার বন্ধু রায়বাহাদুর যা বলছেন তা আমি মেনে নিতে রাজী নই। কারণ আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি, আসামীর ঘরের আর্থিক অবস্থা এতটুকুও সচ্ছল নয়। তাঁর বিধবা মা অতিকষ্টে তাঁর ছেলেকে মানুষ করেছেন, এবং আসামী বরাবর স্কলারশিপ নিয়ে পড়ে এসেছেন। অথচ খোঁজ নিয়ে ও আসামীর ডিসপেনসারীর অ্যাকাউন্ট হতে দেখা যায় প্রথম শুরুতেই এই প্রায় হাজার আড়াই মত টাকা খরচ করা হয়েছে। তাই এখানে প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক নয় কি যে, ঐ টাকাটা কোথা হতে এল?
এ প্রশ্নের জবাব দিতে আমি রাজী নই—কারণ এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার! সুধীন জবাব দেয়।