আর বৃথা সময়ক্ষেপ না করে সোজা কিরীটী ঘরের কোণে ত্রিপয়ের উপর রক্ষিত ফোনটার সামনে এসে দাঁড়ায়। ফোনের রিসিভার তুলে নেয়—Put me to B. B…please!
একটু পরেই ফোনের ওপাশ থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, Yes!
কে, সুব্রত? আমি কিরীটী কথা বলছি। হ্যাঁ, এখুনি একবার আমার এখানে চলে আসতে পারিস? কি বললি—হ্যাঁ, খুব দরকারী কাজ। অ্যা—হ্যাঁ—আরে আয়ই না, সব শুনবি। এখানেই চা হবে, বুঝলি?
সারাটা রাত্রি জেগে চোখমুখ জ্বালা করছে।
কিরীটী অতঃপর স্নানের ঘরে ঢুকে ভিতর দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
ঠাণ্ডা জলে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে জাগরণক্লান্ত শরীরটা যেন জুড়িয়ে স্নিগ্ধ হয়ে গেল। বড় টার্কিস তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে ঘরে এসে ঢুকতেই দেখলে, সুব্রত ইতিমধ্যেই কখন এসে ঘরের মধ্যে একখানি সোফা অধিকার করে সেদিনকার প্রাত্যহিক সংবাদপত্রটা খুলে। বসে আছে।
কি ব্যাপার রে? হঠাৎ এত জরুরী তলব? কিরীটীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সুব্রত মৃদুস্বরে প্রশ্ন করে।
বোস, আমি চট করে জামাকাপড়টা ছেড়ে আসি।
প্রায় আধঘণ্টা পরে এসে কিরীটী ঘরে প্রবেশ করল, পরিধানে নেভি-র সার্জের লং প্যান্ট, গায়ে হাতকাটা স্ট্রাইপ দেওয়া গরম সার্ট। মুখে পাইপ।
কৃষ্ণা ইতিমধ্যে ট্রেতে করে চায়ের সরঞ্জাম টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে গেছে, সুতর সামনে ধূমায়িত চায়ের কাপ। পাশে বসে কৃষ্ণা।
কিরীটী এগিয়ে এসে সুব্রতর পাশ ঘেঁষে সোফার ওপরে বসে পড়ল। কৃষ্ণা হাত বাড়িয়ে কাপের মধ্যে দুধ চিনি ঢেলে টি-পট থেকে চা ঢালতে লাগল।
তারপর, হঠাৎ এত জরুরী তলব কেন?
কিরীটী কোনো মাত্র ভূমিকা না করেই বলতে শুরু করে, জানিস, রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের হত্যা-মামলায় দণ্ডিত অপরাধী ডাঃ সুধীন চৌধুরীর মা গতরাত্রে তোরা সব চলে যাওয়ার পর এসেছিলেন এখানে আমার কাছে!
কৃষ্ণা বললে, কাল রাত্রে কখন?
কিরীটী বললে, তুমি ঘুমিয়ে ছিলে, তোমায় জাগাইনি–
সুব্রতও কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়, বলে, সত্যি? তা হঠাৎ তাঁর তোর এখানে আসার কারণ? মামলার তো রায় বেরিয়ে গেছে! নাটকের পরে তো যবনিকাপাত হয়ে গেছে!
তা হয়েছে, তবে দেখলাম তাঁর ও আমার মতটা প্রায় একই, মামলার একটা লোক-দেখানো সমাপ্তি ঘটলেও আসলে এখনও অনেক কিছুই অসমাপ্ত রয়ে গেছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, সে এক কাহিনী।
বুঝলাম। কিন্তু আসল ব্যাপারটা কি বল তো?
আসল ব্যাপারের জন্যই তো এই এত সক্কালেই তোকে ডাকতে হল। কিরীটী চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মৃদুভাবে বলে।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
কিরীটী তখন গতরাত্রের সমস্ত কথা যথাসম্ভব বিশদভাবে সুব্রতকে বলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে।
হুঁ—তাহলে তুই কেসটা হাতে নিলি বল?
হ্যাঁ—উপায় ছিল না।
কিন্তু
যতদূর মনে হয় ডাঃ সুধীন চৌধুরী নিদোষ। অবিশ্যি যদি আমার বিচারে ভুল না হয়ে থাকে।
তা যেন হল, কিন্তু আইনের চোখে যে একবার দোষী প্রমাণিত হয়ে কারাগারে গিয়ে ঢুকেছে, তাকে মুক্ত করা ব্যাপারটা কি খুব সহজ হবে বলে ভাবিস তুই?
তার নির্দেষিতা প্রমাণ করতে পারলে কেসটা রি-ওপেন করা হয়তো কঠিন হবে বলে মনে হয় না। শোন্এখন তোকে আমার একান্ত প্রয়োজন, যার জন্য তোকে এত সকালে তাড়াহুড়ো করে টেনে নিয়ে এলাম। এই মামলার বিচারক ছিলেন জাস্টিস্ মৈত্র। তাঁর সঙ্গে আমার কিছুটা আলাপ-পরিচয় আছে, তোকে এখুনি একটিবার ল্যান্সডাউন রোডে জাস্টিস মৈত্রের ওখানে আমার একটা চিঠি নিয়ে যেতে হবে। রায়পুরের মামলার বাদী ও বিবাদী পক্ষের সমস্ত সাক্ষীসাবুদের প্রসিডিংসগুলো পড়ে যথাসম্ভব নোট করে আনবি, যেমন যেমন প্রয়োজন বুঝবি। আমাদের এখন শুরু করতে হবে শেষ থেকে। শেষের দিক থেকে কাজ শুরু করে ধীরে ধীরে আমরা গোড়ার দিকে যাব এগিয়ে।
বেশ। তাহলে আমি উঠি, তুই চিঠিটা লিখে ফেল্।
তুই বোস্ একটু, চিঠিটা এখুনি আমি লিখে দিচ্ছি।
কিরীটী সোফা থেকে উঠে রাইটিং টেবিলের সামনে বসে তার লেটার প্যাডে একটা চিঠি লিখে খামে এঁটে সুব্রতর হাতে এনে দিল, এই নে।
১.০৬ জাস্টিস মৈত্র
জাস্টিস মৈত্র লোকটি অত্যন্ত রাশভারী।
বছর কয়েক আগে একটা খুনের মামলা যখন তাঁর এজলাসে চলছিল, কিরীটীর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। ক্রমে সেই আলাপ ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়।
সুব্রতর হাত থেকে কিরীটীর দেওয়া চিঠিটা খুলে, চিঠিখানি পড়ে স্মিতভাবে জাস্টিস্ মৈত্র বললেন, রহস্যভেদী কি আমার রায়কে নাকচ করবার মতলবে আছেন নাকি সুব্রতবাবু?
সুব্রত মৃদু হাস্যসহকারে জবাব দিল, তা তো ঠিক বলতে পারি না। তবে আমার যতদূর মনে হয়, সে বোধ হয় কেষ্টা সম্পর্কে একটু interested!
উঁহুঁ। ব্যাপারটা তা আমার ঠিক মনে হচ্ছে না। যা হোক ওপরে চলুন আমার studyতে, কাগজপত্র আমার সব সেখানেই থাকে—কিন্তু সে তো কুরুক্ষেত্র ব্যাপার!
সুব্রত জাস্টিস মৈত্রের আহ্বানে উঠে দাঁড়ায়, উপায় কি বলুন! সেই কুরুক্ষেত্রই এখন ঘাঁটতে হবে। চলুন।
দোতলায় ওপর বেশ প্রশস্ত একখানা ঘর। ঘরের মেঝেতে পুরু গালিচা বিস্তৃত, ধনী আভিজাত্যের নিদর্শন দিচ্ছে। মধ্যিখানে বড় সেক্রেটারিয়েট একটা টেবিল, খান-পাঁচেক গদী-মোড়া দামী চেয়ার।
চারপাশে দেওয়ালে আলমারি ঠাসা সব নানা আকারের আইনের কিতাব।