কিন্তু সুহাস মল্লিকের হত্যা যখন প্রমাণিত হয়েছে-আদালত ব্যাসিলাইয়ের প্রয়োগ ব্যতীত প্লেগ এবং প্লেগে মৃত্যুর যখন অন্য কোনো কারণ প্রমাণ করতে পারেনি; সে অবস্থায় একমাত্র বম্বের ইনসটিটিউটের ব্যাসিলাই ছাড়া প্লেগ কালচার অন্য কোথা হতেই বা সংগৃহীত হতে পারে? অবিশ্যি মামলার সময় বিভিন্ন বাদী ও প্রতিবাদীর জবানবন্দি থেকেও সেটাই প্রমাণিত হয়েছে একপ্রকার যে বম্বে থেকেই প্লেগবীজাণু আনা হয়েছিল। বাংলাদেশে আজ দীর্ঘকাল ধরে কোনো প্লেগ কেস হয়নি।
তাই চারিদিক বিবেচনা করে এইটাই ধরে নেওয়া হয়েছে যে, প্লেগ ব্যাসিলাই আনা হয়েছে নিশ্চিত বম্বে হতে এবং তারই সাহায্যে এই দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছে ষড়যন্ত্র করে।
অবিশ্যি মামলার সময় প্রমাণিত হয়নি সঠিকভাবে যে কেমন করে আনীত হয়েছে বম্বে হতে প্লেগ ব্যাসিলাই। শুধুমাত্র এইটুকুই প্রমাণিত হয়েছে যে, সুহাস মল্লিককে হত্যা করা হয়েছে প্লেগ ব্যাসিলাই ইনজেক্ট করে। কেননা মৃত্যুর পূর্বে তার রক্তের কালচার-রিপোর্ট থেকে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। এই গেল মামলার মূল প্রথম কথা।
দ্বিতীয় কথা : ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে কেন সুহাসের হত্যা-মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হল বিচারে? অবিশ্যি গত ৩১শে মে রাত্রে শিয়ালদহ স্টেশনে যখন সুহাস মল্লিককে আততায়ী। (?) প্লেগ ব্যাসিলাই ইজেকট করে (?), সেই সময় সুধীন সুহাসের একেবারে পাশটিতেই ছিল। এবং একমাত্র নাকি সেই কারণেই জজসাহেব ও জুরীদের বিচারে সুধীনের পক্ষে। সুহাসকে ঐ সময় প্লেগ ব্যাসিলাই ইনজেকট করা খুবই সম্ভবপর ছিল—যদিও সেটা প্রমাণিত হয়নি এবং এও প্রমাণিত হয়নি যদি তাই ঘটে থাকতো, কিভাবে সেই প্লেগ ব্যাসিলাই সুধীন ডাক্তার যোগাড় করেছিল। সুধীন ডাক্তারও বটে। এ ছাড়া মোটিভ বা উদ্দেশ্য এক্ষেত্রে। একটা ছিল, যেমন প্রতিহিংসা। এবং প্রতিহিংসা যে নয় তাই বা কে বললে? পিতার নৃশংস হত্যার প্রতিশোেধ প্রত্যক্ষে সন্তানের পক্ষেই নেওয়া স্বাভাবিক বলতে হবে। কিন্তু সুধীন ও সুহাসের পরস্পরের মধ্যে ইদানীং যে সৌহার্দ্য বা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল, সেই দিক দিয়ে বিচার করে দেখতে গেলে সুধীনের পক্ষে সুহাসকে ঐরকম নৃশংসভাবে হত্যা করাটা কি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়?
বিচারক ও জুরীদের মত, ডাঃ সুধীন চৌধুরী নাকি সময় ও সুযোগের প্রতীক্ষ্ণয় ছিল এতদিন। এবং সুযোগ পাওয়া মাত্রই সে সুযোগটার সদ্ব্যবহার করছে।….এও তাদের মত যে, পিতার হত্যার প্রতিশোধলিন্দু সুধীন অদূর ভবিষ্যতে যাতে করে অনায়াসেই অন্যের সন্দেহ বাঁচিয়ে সুহাসকে হত্যা করতে পারে, সেই জন্যই একটা লোক-দেখানো ঘনিষ্ঠতা বা সৌহার্দ্য সুহাসের সঙ্গে ইদানীং কয়েক বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে তুলেছিল। কিন্তু কিরীটী ভাবে, তাই যদি সত্যি হয়, তবে সুধীন প্রতিহিংসার পাত্র হিসাবে রায়পুরের রাজগোষ্ঠীর অন্য সকলকে বাদ দিয়ে নিরীহ গোবেচারী সুহাসকেই বা বেছে নিল কেন? সুধীনের পিতাকে যখন নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তখন সুহাসের তো মাত্র তিন বৎসর বয়স। এবং তার সেই শিশুবয়েসে আর যাইহোক সেদিনকার সেই নিষ্ঠুর হত্যার ব্যাপারের সঙ্গে তার কোনোক্রমেই জড়িত থাকাটা তো সম্ভবপর নয়—সেদিক দিয়ে তাকেই প্রতিশোধের পাত্র হিসাবে বেছে নেওয়া হল কেন?
তবে যদি এই হয় যে, রাজগোষ্ঠীর একজনকে কোনোমতে হত্যা করতে পারলেই তার পিতার প্রতিশোধটা অন্তত নেওয়া হয়, সেটা অবশ্য অন্য কথা। কারণ মানুষের সত্যিকারের মনের কথা বোঝা শুধু অসম্ভবই নয়, একেবারে হাস্যকর বলেই মনে হবে।
তারপর একটু আগে শোনা সুধীনের মার মুখে সেই সুধীনের পিতার অতীতের নৃশংস হত্যাকাহিনী, সেও শুধু একমাত্র সুধীনের পিতার হত্যাই নয়, তার আগে শ্রীকণ্ঠ মল্লিককেও তো হত্যা করা হয়েছিল একই ভাবে এবং একই স্থানে! আগাগোড়া সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সমগ্র কাহিনীটি বিবেচনা করে দেখতে গেলে প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত হয়ত বা দেখা যাবে, সব কিছুই একই সূত্রে গাঁথা।
অবিশ্যি এও হতে পারে, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক ও সুধীনের পিতার হত্যা-ব্যাপারে সুহাসের হত্যা-রহস্য হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। একটার সঙ্গে অন্যটার কোনো যোগসূত্ৰই নেই।
কিরীটীর মনের মধ্যে নানা চিন্তা এলোমেলো ভাবে যেন একটার পর একটা আনাগোনা করতে থাকে। এ যেন মাকড়সার জাল, কোথায় শেষ কে জানে! যেমন অসংবদ্ধ তেমনি জটিল।
ইতিমধ্যে কখন একসময় প্রথম ভোরের আলো শীতরাত্রির অবসান ঘটিয়েছে, তা কিরীটী টেরও পায়নি।
প্রভাতের ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া খোলা বাতায়নপথে এসে জাগরণক্লান্ত কিরীটীর চোখেমুখে স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায়।
আর ঘুমের আশা নেই। কিরীটী শয্যা থেকে উঠে জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়।
রাস্তার ধারের কৃষ্ণচূড়ার গাছটার পত্রবহুল শীর্ষ ছুঁয়ে ভোরের শুকতারা তখনও জেগে আছে দেখা যায়।
কিরীটী চিন্তা করতে থাকে, এখন কি কর্তব্য? কোন্ পথে কোন্ সূত্র ধরে এখন সে। অগ্রসর হবে? তবে এটা ঠিক, অগ্রসর হতে হলে আগাগোড়া আবার সমস্ত মামলাটাকেই তীক্ষ্ণ বিচার দিয়ে গোড়া হতে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, আর তাই যদি হয়, এ-ব্যাপারে বর্তমানে যিনি তাকে সত্যি সাহায্য করতে পারেন, তিনি হচ্ছেন জাস্টিস্ মৈত্র। হ্যাঁ ঠিক, জাস্টিস্। মৈত্র!