তান্ত্রিক কালীসাধক পিতা ঘরের দুয়ার বন্ধ করে মা-কালীর সাধনা শুরু করলেন। মধ্যরাত্রে পাড়ার লোকেরা শুনত, তন্ত্রধারী কালীসাধকের পূর্ণ হোমের গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ। ভয়ে বুকের মধ্যে যেন সবার ছমছম করে উঠত!
গগন মুখার্জী যখন আকস্মিক অভাবনীয়রূপে ম্যানিজাইটিস হয়ে মাত্র তিন দিনের মধ্যে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন, অনেকেই বলেছিল সেই সময়কালীসাধক তান্ত্রিক ডাঃ মুখার্জীর পিতা নাকি মৃত্যুবাণ চালিয়েছিলেন। অমোঘ সে মৃত্যুবাণ।
একবার কারও প্রতি নিক্ষিপ্ত হলে, সে নিক্ষিপ্ত বাণাঘাতে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু। কারও সাধ্য নেই ধ্বংস হতে তাকে রক্ষা করে।
কিন্তু সে যাই হোক, এর পর আদালতে রায়পুরের বিখ্যাত হত্যা-মামলা শুরু হল। বর্তমান উপাখ্যানের সে এক চাঞ্চল্যকর অধ্যায়।
আদালতে তিলধারণের স্থান নেই, অগণিত দর্শক। হত্যাপরাধে অন্যতম অভিযুক্ত আসামী, শহরের স্বনামধন্য প্রখ্যাতনামা চিকিৎসক ডাঃ কালীপদ মুখার্জী। তাছাড়া সেই সঙ্গে আছেন নিহত ছোট কুমারের জেষ্ঠ ভাই, রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক ও রাজবাড়ির পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ অমিয় সোম।
বিচিত্র মামলার বিচিত্র আসামী!
একজন চিকিৎসক, যার পেশা মানুষের সেবা, যার হাতে নির্বিচারে মানুষ মানুষের অতি প্রিয় আপনার জনের মরণ-বাঁচনের সকল দায়িত্ব অকুণ্ঠিত চিত্তে নির্ভয়ে ও আশ্বাসে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে। আর একজন একই পিতার সন্তান, একই রক্তধারা হতে জন্মেছে যে ভাই সেই ভাই। সত্যিই কি এক বিচিত্র নাটক!
পাবলিক প্রসিকিউটার গগন মুখার্জী যখন ডাঃ কালীপদ মুখার্জীর নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করেন, তখন তিনি কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়েছিলেন, এ ভয়ংকর হত্যারহস্যের পিছনে আসল মেঘনাদই হচ্ছে শয়তানশিরোমণি চিকিৎসক ডাঃ কালীপদ মুখার্জী! সেই হচ্ছে আসল brain, তারই বুদ্ধিতেই এ হত্যার ব্যাপার ঘটেছে। অন্যান্য সবাই হত্যার ব্যাপারে instrument মাত্র! এও নিশ্চিত, সুহাসের শরীরে শত্রুতা করে Plague Bacilli inject করে দেওয়া হয়েছে কোনো উপায়ে এবং সেই উপায়ে একজন সুস্থ ব্যক্তিকে হত্যা করবার যে বিচিত্র প্রচেষ্টা, তা একজন ডাক্তারের brain ছাড়া সাধারণ লোকের মাথায় আদপেই সম্ভবপর নয়। It is simply impossible for a common man-with a common ordinary brain. আরও ভেবে দেখবার বিষয়, ডাঃ রায় রোগী দেখে যখন সন্দেহ করেন তখন ডাঃ মুখার্জী কেন blood culture-এ বাধা দেন! এসব ছাড়াও গগন মুখার্জীর সরকারী মহলে ছিল অসাধারণ প্রতিপত্তি—তিনি বলেছিলেন, কোনো বিশেষ কারণবশতই বর্তমানে এ কেস্ সম্পর্কে যাবতীয় evidences তাঁকে গোপন করে রাখতে হচ্ছে। যা হোক তাঁর দুর্ভাগ্যবশত ও আসামীদের সৌভাগ্যবশতঃ, তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে সব ওলটপালট হয়ে গেল, গোপনীয় দলিলপত্রের কোনো সন্ধানই পাওয়া গেল না—তবু মামলা চলল দীর্ঘদিন ধরে। প্রমাণিত হল, ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের দেহে Plague Bacilli inject করেই তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত গগন মুখার্জীর মৃত্যু হওয়ায় ডাঃ মুখার্জীর স্বপক্ষে নানাপ্রকার সাক্ষীসাবুদ খাড়া করে প্রমাণিত করা হল যে অতীতে পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য ডাঃ সুধীন চৌধুরীই সেদিন অর্থাৎ ৩১শে মে শিয়ালদহ স্টেশনে রায়পুর যাওয়ার সময় ছোট কুমারের দেহে অলক্ষ্যে প্লেগ ব্যাসিলাই inject করে দিয়েছিল।
তাছাড়া আরও একটা কথা, যে কলকাতা শহরে আজ আট-দশ বৎসরের মধ্যে একটি প্লেগ কেসও দেখা দেয়নি, সেখানে কারও প্লেগে মৃত্যু হওয়াটা সত্যিই কি বিশেষ সন্দেহজনক নয়? কোথা থেকে শরীরে তার প্লেগের বীজাণু এল? এই প্রকার সব সাত-পাঁচে ব্যাপারটা কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল।
যা হোক-ডাঃ মুখার্জীর বিপক্ষে কোনো অভিযোগই প্রমাণ করা গেল না। ডাঃ মুখার্জী ও সুবনিয় মল্লিক দুজনেই বেকসুর খালাস পেলেন আর হত্যাপরাধে ডাঃ সুধীন চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাবাসের আদেশ হল ও তার মেডিকেল ডিগ্রী ও রেজিস্ট্রেশন বাজেয়াপ্ত করা হল। নাটকের উপর যবনিকাপাত হল।
কিন্তু আসল নাটকের শুরু কোথায়?
যবনিকাপাতের পূর্বে যে নাটকের মহড়া বসেছিল, তার মূল কোথায়?
হতভাগ্য ডাঃ সুধীনের মাকে বিদায় দিয়ে কিরীটী নিজের শয়নকক্ষে এসে শয্যার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে কাল রাত্রের সেই কথাই ভাবছিল।
এ কথা অবশ্যই অবধারিত সত্য যে, ছোট কুমারকে প্লেগ ব্যাসিলাই ইনজেক্ট করেই হত্যা করা হয়েছে।
কিন্তু আদালত স্থির করতে পারে নি, সেই প্লেগ ব্যাসিলাই এল কোথা থেকে? এবং এলই যদি, সেই প্লেগ ব্যাসিলাই কে আনলে এবং কেমন করেই বা আনলে!
কারণ একমাত্র সারা ভারতবর্ষে বম্বেতে প্লেগ ইনসটিটিউট আছে; সেখানে প্লেগ রোগ সম্পর্কে রিসার্চ করা হয়। সে রিসার্চ ইনসটিটিউট সম্পূর্ণরূপে গভর্ণমেন্টের কর্তৃত্বাধীনে। ইনসটিটিউটের কর্তৃপক্ষের আদেশ বা সম্মতি ব্যতীত সেখানে কারও প্রবেশ অসম্ভব। একমাত্র যারা সেখানে কর্মচারী ছাত্র বা ও-ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট তারা ভিন্ন সেখানে কারও প্রবেশও নিষেধ। তাছাড়া সেই ইনষ্টিটিউটের প্রতিটি জিনিসপত্রের চুলচেরা হিসাব প্রত্যহ রাখা হয় সুষ্ঠুভাবে, সেখান থেকে কোনো জিনিস ওখানকার কর্তৃপক্ষের অজ্ঞাতে সরিয়ে আনা কেবল কঠিনই নয়,একপ্রকার অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না।