সেই রিপোর্ট তখুনি সঙ্গে করে নিয়ে সন্ধ্যার একটু পরেই কর্ণেল স্মিথ স্বয়ং ডাঃ রায়ের হাতে পৌঁছে দিয়ে এলেন। কারণ তিনি ডাঃ মিত্রের কাছ থেকে শুনেছিলেন, ওটা ডাক্তার রায়ের সুপারিশেই কালচারের জন্য নাকি এসেছিল, তাছাড়া অন্য কারণও ছিল।
সে যা হোক, বিদ্যুৎগতিতে সে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল সারাটা কলকাতা শহরে চিকিৎসকদের মহলে। এবং ক্রমে সেই কথাটা পাবলিক প্রসিকিউটার গগন মুখার্জীর কানে এসে উঠল। গগন মুখার্জী যেন হঠাৎ উঠে বসলেন। আরও দুচার দিন গোপনে খোঁজখবর চলল, তারপর আকস্মিক একদিন সন্ধ্যার ঠিক আগে—পাবলিক প্রসিকিউটার রায়বাহাদুর গগন মুখার্জী, রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের খুনের দায়ে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বের করে একই সঙ্গে ডাঃ মুখার্জী, সুবিনয় মল্লিক, ডাঃ অমিয় সোম এবং আরও দু-চারজনকে গ্রেপ্তার করে একেবারে হাজতে পুরলেন।
শহরে রীতিমত এক চাঞ্চল্য দেখা দিল। কারণ সংবাদটা যেমনি অভাবনীয় তেমনি চাঞ্চল্যকর।
জামিনে ওদের খালাস করার জন্য তদ্বির শুরু হল।
কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ গগন মুখার্জী কঠিনভাবে মাথা নাড়লেন, জামিনে কারও খালাস হবে না। যতদিন না মামলার মীমাংসা হয়, কারও জামিন মিলবে না। অভিযোগ হত্যা ও হত্যার ষড়যন্ত্র! এবং নিশ্চিত প্রমাণ-সূত্র সরকার বাহাদুরের হাতে পৌঁছে গেছে।
তদন্ত শুরু হল।
গগন মুখার্জী আবশ্যকীয় সব প্রমাণাদি যোগাড় করতে লাগলেন নানা দিক থেকে। গগন মুখার্জীর সবচাইতে বেশী রাগ যেন ডাঃ মুখার্জীর ওপরেই। কিন্তু তারও একটা কারণ ছিল বৈকি। অতীতের কুহেলী আচ্ছন্ন। অথচ কেউ সে কথা জানত না। ঐ ঘটনার বছর চার আগে, পাবলিক প্রসিকিউটার গগন মুখার্জীর বড় মেয়ে কুন্তলা আত্মহত্যা করে।
কুন্তলার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ষড়যন্ত্র করে তাদের পুত্রবধূ কুন্তলাকে পরিত্যাগ করে। কুন্তলার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে এই অভিযোগে ছেলের আবার বিবাহ দেয়। কুন্তলা যে সত্যিসত্যিই পাগল হয়ে গেছে সে সাটিফিকেট দিয়েছিল ঐ ডাঃ মুখার্জীরই মেডিকেল বোর্ড যে বোর্ডে তিনি একজন পাণ্ডা ছিলেন। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা আগাগোড়া কুন্তলার শ্বশুবাড়ির লোকের পক্ষ থেকে সাজানো। কুন্তলাকে ত্যাগ করবার একটা অছিলা মাত্র। নিষ্ফল আক্রোশে নির্বিষ সাপের মতই সেদিন গগন মুখার্জী ছটফট করেছিলেন। উপায় নেই। নিষ্করুণ ভাগ্যের নির্দেশকেই সেদিন মেনে নিতে হয়েছিল সানেত্রে।
অনেক চেষ্টা করেও ডাঃ মুখার্জীর বিরুদ্ধে তিনি কোনো অভিযোগ খাড়া করতে পারেন নি সেদিন। লজ্জায়, দুঃখে, অপমানে কুন্তলা আত্মহত্যা করে সকল জ্বালা জুড়লো।
শ্মশানযাত্রীরা শবদেহ এনে উঠোনের ওপরে নামিয়েছে—চেয়ে রইলেন—দুচোখের কোল বেয়ে অজস্র ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।
কন্যার মৃতদেহ স্পর্শ করে মনে মনে সেদিন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, মাগো, তোর দুঃখ আর কেউ না বুঝলেও, আমি বুঝেছিলাম। এর প্রতিশোধ আমি নেব।
হ্যাঁ, প্রতিশোধ! এর প্রতিশোধ তাঁকে নিতেই হবে!
আজ তিনি ডাঃ মুখার্জীকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েছেন। এতবড় সুবর্ণ সুযোগ!
***
হাজত-ঘরে ডাঃ মুখার্জী বসে কত কথাই ভাবতে লাগলেন। কিন্তু বের হবার উপায় নেই। সরকার জামিনও দেবে না বলে দিয়েছে।
আর গগন মুখার্জী মনে মনে দাঁত চেপে বললেন, এই যে যজ্ঞ শুরু করলাম, এর পূর্ণাহুতি হবে সেইদিন, যেদিন মুখার্জীকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে পারব।
কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস!
আর মাত্র তিনদিন আছে মামলা আদালতে শুরু হবার।
গগন মুখার্জীর বাড়ির গেটে ও চতুম্পার্শ্বে সশস্ত্র প্রহরী দিবারাত্র পাহারা দিচ্ছে তাদের রাইফেলের সঙ্গীন উঁচিয়ে, যাতে করে শত্রুপক্ষের লোকেরা কেউ মামলা শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত গগন মুখার্জীর কোনো প্রকার দৈহিক ক্ষতি না করতে পারে। কারণ সে ভয় তাঁর খুবই ছিল।
এমন সময় সহসা গগন মুখার্জীর একদিন সন্ধ্যার সময় জ্বর এল, জ্বরের ঘোরে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। কলকাতা শহরের বড় বড় ডাক্তাররা এলেন, তাঁরা মাথা নেড়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, ব্যাধি কঠিন, ভিরুলেন্ট টাইপের ম্যানিনজাইটিস্-জীবনের আশা খুব কম।
জলের মত অর্থব্যয় হল, চিকিৎসার কোনো ক্রটি হল না—কিন্তু সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেল। সাজানো দাবার ছক ফেলে, মাত করবার পূর্বেই এতদিনকার অতৃপ্ত প্রতিশোধের দুর্নিবার স্পৃহা বুকে চেপেই পাবলিক প্রসিকিউটারর গগন মুখার্জী কোনো এক অজানা লোকের পথে পা বাড়ালেন।
লোকমুখে সেই সংবাদ জেলের মধ্যে বন্দী ডাঃ মুখার্জীর কানে পৌঁছল, তিনি বোধ করি আজ অনেক দিন পরে বুকভরে আবার নিঃশ্বাস নিলেন। ঘাম দিয়ে বুঝি জ্বর ছাড়ল।
১.০৫ মাকড়সার জাল
যাঁর প্রতিবন্ধকতায় ডাঃ মুখার্জীর জামিন পাওয়া কোনোমতে সম্ভব হচ্ছিল না, তাঁর আকস্মিক অভাবনীয় মৃত্যুতে এতদিন পরে তা সম্ভব হল।
ডাঃ মুখার্জীর বৃদ্ধ পিতা তান্ত্রিক, কালীসাধক।
লোকে বলত, তিনি নাকি বলেছিলেন, যেমন করেই হোক কালীকে আবার আমি মুক্ত করেই আনব, আমার মা-কালীর সাধনা যদি সত্য হয়। সত্যিসত্যিই যদি আমি দীর্ঘ আঠারো বছর একাগ্রচিত্তে মা-কালীর পূজা করে এসে থাকি, তবে এ জগতে কারও সাধ্য নেই আমার একমাত্র সন্তানকে আমার বুক থেকে এমনি করে অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে পারে।