এবং সুবিনয়ও সেই সঙ্গে সায় দিতে লাগল। তথাপি রাণীমা বলতে লাগলেন, তা হোক, ডাঃ মুখার্জীকে তার করে দেওয়া হোক, কলকাতা থেকে একটিবার এসে তিনি সুহাসকে যত শীঘ্র সম্ভব দেখে যান।
এবং শেষ পর্যন্ত তার করেও দেওয়া হল। আর তার পেয়ে ডাঃ মুখার্জী রায়পুর এসে হাজির হলেন।
ডাঃ মুখার্জীর বয়স চল্লিশের কিছু উপরেই হবে। থলথলে নাদুসনুদুস গড়ন। লম্বা-চওড়া চেহারা। গায়ের রং কাঁচা হলুদের মত। সৌম্য প্রশান্ত। মাথার সামনেয় সামান্য টাক পড়েছে। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।
দেখলেই মনে হয় যেন একটা সাহস বা নিরাপত্তার ভাব আসে রোগীর মনে।
ডাঃ মুখার্জী এসে সুহাসের কক্ষে প্রবেশ করলেন, কি হে সুহাসচন্দ্র? আবার অসুখ বাধিয়েছ? তুমি যে ক্রমে একটি রোগের ডিপো হয়ে উঠলে হে!
সুহাস ক্লান্ত স্বরে বলে, বড় দুর্বল লাগছে ডাঃ মুখার্জী।
ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আশ্বাস দেন ডাঃ মুখার্জী।
পরীক্ষার পর মালতী দেবী জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন দেখলেন ডাঃ মুখার্জী সুহাসকে?
ডাঃ মুখার্জী বলেন, ভয়ের কিছু নেই, ভাল হয়ে যাবে।
কিন্তু তবু ডাঃ মুখার্জীকে মালতী দেবী পাঁচ-ছয়দিন রায়পুরেই আটকে রাখলেন, ছাড়লেন না, বললেন, ওকে একটু সুস্থ না করে আপনি যেতে পারবেন না।
কিন্তু সুহাসের অসুখের কোনো উন্নতিই হল না পাঁচ-ছ দিনেও।
ক্রমেই সুহাস যেন বেশী অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল। মালতী দেবী এবারে কিন্তু বিশেষ চিন্তিত হয়ে উঠলেন, মনের মধ্যে কেমন যেন একটা আশঙ্কা থমথম করে।
শেষটায় মালতী দেবী বেঁকে বসলেন, সুহাসকে কলকাতায় নিয়ে যেতেই হবে; এ আমার মোটেই ভাল লাগছে না ডাঃ মুখার্জী কলকাতাতেই ওকে নিয়ে চলুন, সেখানে আরও দু-একজনের সঙ্গে কনাসা করুন।
ডাঃ মুখার্জী অনেক বোঝালেন, কিন্তু মালতী দেবী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইতিমধ্যে হঠাৎ সুহাসের একখানা চিঠি পেয়ে ডাঃ সুধীন রায়পুরে এসে হাজির হল। সেও বললে, এ অবস্থায় কলকাতায় নিয়ে যাওয়াই বোধ হয় ভাল হবে।
অবশেষে সত্যিসত্যিই একপ্রকার জোর করেই যেন মালতী দেবী অসুস্থ সুহাসকে ডাঃ মুখার্জী ও সুধীনের তত্ত্বাবধানে কলকাতার বাসায় নিয়ে এসে তুললেন।
সুধীন কিন্তু কলকাতায় আসবার পরের পরের দিনই জরুরী একটা কাজে বেনারস চলে গেল।
আরও বড় বড় ডাক্তার ডাকা হল, সার্জেন, ফিজিসিয়ান কেউ বাদ গেল না।
নানা মুনির নানা মত। নানা চিকিৎসা-বিভ্রাট চলতে থাকে যেমন সাধারণত হয় অর্থের প্রাচুর্য থাকলে।
অবশেষে পূর্ব কলকাতার একজন প্রখ্যাতনামা চিকিৎসক ডাঃ রায় এসে রোগী দেখে ডাঃ মুখার্জীকে বললেন, রক্তটা একবার কালচার করবার জন্য পাঠানো হোক ডাঃ মুখার্জী। সবই তো করে দেখা হল।
ডাঃ মুখার্জী প্রশ্ন করলেন, রক্ত কালাচার করে কি হবে ডাঃ রায়?
রোগীর গ্ল্যাণ্ডসগুলো দেখে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে, মনে হচ্ছে, প্লেগের মত, যেন গ্ল্যাণ্ডসগুলো ফুলেছে।
ডাঃ মুখার্জী হাঃ হাঃ করে উচ্চেঃস্বরে হেসে উঠলেন, প্লেগ! ঐ সমস্ত চিন্তাটা আপনার মাথায় এল কি করে—তাও আজকের দিনে!
ডাঃ মুখার্জী হাসতে লাগলেন।
হাসবেন না ডাঃ মুখার্জী। সব রকমই তো করা হল, ওটাও না হয় করে দেখলেন, এমন কি ক্ষতি! তাছাড়া আমার মনে হয় এক্ষেত্রে সেটা প্রয়োজনও। শেষের দিকে তাঁর কণ্ঠস্বরে বেশ একটা দৃঢ়তা যেন ফুটে ওঠে।
না, ক্ষতি আর কি, তবে absolutly unnecessary! কিন্তু আপনি যখন বলছেন, পাঠানো হোক। কতকটা অনিচ্ছাতেই যেন রক্ত কালচার করবার মত দিলেন ডাঃ মুখার্জী।
যাই হোক, ব্লাড নেওয়া হল কালচারের জন্য, ট্রপিক্যাল স্কুলেও পাঠানো হল। কিন্তু রক্তের কালচারের রিপোট আসবার আগেই, অর্থাৎ পরদিন সকালেই সুহাসের আকস্মিক মৃত্যু ঘটল।
ডাঃ মুখার্জী ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন, যথানিয়মে শবদেহের দাহকার্যও সুসম্পন্ন হয়ে গেল।
***
সুহাসের মৃত্যুর দুতিনদিন পরে। সুধীন আবার বেনারস থেকে ফিরে এসে সব শুনলে, কিন্তু একটি কথাও ভাল-মন্দ কিছুই বললে না। নিঃশব্দে কেবল ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল—ঘরে তখন অন্যান্য সবাই বসেছিল।
এদিকে ট্রপিক্যাল স্কুলের ল্যাবরেটরী রুমে অধ্যক্ষ কর্ণেল স্মিথ কতকগুলি কালচার-টিউব নিয়ে পরীক্ষা করছেন।
বিকেল প্রায় পাঁচটা, ল্যাবরেটরীর কর্মীরা সকলেই প্রায় যে যাঁর কাজকর্ম শেষ করে বাড়ি চলে গেছেন।
এমন সময় কর্ণেল স্মিথের সহকারী ও ছাত্র ডাঃ মিত্র, কর্ণেলের সামনে একটা কালচার-টিউব নিয়ে এসে দাঁড়ালেন, স্যার!
ইয়েস, ডাঃ মিত্র—? কর্ণেল ডাঃ মিত্রের দিকে মুখ তুলে চাইলেন।
দেখুন তো–এই কালচার-টিউবটা! প্লেগ ব্যাসিলাইয়ের গ্রোথ বলেই যেন সন্দেহ হচ্ছে!
What! Plauge growth! Let me see! Let me see!
ব্যগ্রভাবে কর্ণেল কালচার-টিউবটা হাতে নিয়ে টিউবের ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। উত্তেজনায় তাঁর চোখের তারা দুটো যেন ঠিকরে বের হয়ে আসতে চায়।
Yes! It is nothing but Plague! Yes, its Plague!
তখুনি গিনিপিগের শরীরে সেই কালচার-টিউবথেকেগ্রোথ নিয়ে ইনজেক্ট করা হল পরীক্ষার জন্য। এবং খোঁজ করে জানা গেল, রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের যে রক্ত কালচার করতে ডাঃ মুখার্জী পাঠিয়েছিলেন, এ তারই কালচার।
পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হল, সেটা যথার্থই প্লেগ ব্যাসিলাইয়ের গ্রোথ।