পাঠ্য সহচর
আমাদের গ্রামের মক্তব গুলোতে শিক্ষার বিভাগ ছিল মাত্র দুটি – সাহিত্য ও অঙ্ক। এছাড়া শিক্ষার অন্যান্য বিভাগগুলো আমার ছিল অজানা। ভূগোল, ইতিহাস ও ব্যাকরণ এ নামগুলো সবে মাত্র জানলাম ।
সদ্য প্রাপ্ত বই-পুথি গুলো নাড়াচাড়া করে দেখলাম এবং ধীরে ধীরে কিছু পড়লাম। পুথিগুলো নিয়ে বেশী ঘাটাঘাটি করলাম না। কারণ আমার প্রতিবেশী আঃ রহিম ফরাজী ছিলেন ভাল একজন পুথি পাঠক। ভাবলাম যে, পুথি গুলো তাকে দিয়া পড়াব ও তার সঙ্গে পড়বার চেষ্টা করব। বইগুলো পড়ে – গল্প ও ইতিহাস কিছু বোঝতে পারলাম, ভূগোল বোঝলাম যৎসামান্য কিন্তু ব্যাকরণ “না” বল্লেই চলে। ব্যাকরণ বাদ রেখে আমি – গল্প, ইতিহাস ও ভূগোল পড়তে লাগলাম। আমার পড়ার কোন রুটিন ছিল না; সকাল-বিকাল, সন্ধ্যা-দুপুরও ছিল না; ছিল – যখন যা ইচ্ছা, তখন তা পড়া। শুধুই পড়া।
বার বার বই গুলো পড়ে একটা ফল পেতে লাগলাম। দেখা গেল যে, যে কোনও বই পড়ে প্রথম বার যা বোধগম্য হচ্ছিল, দ্বিতীয় বারে হচ্ছে তার চেয়ে বেশী, তৃতীয়বারে তার চেয়ে বেশী এবং চতুর্থ বারে আরো বেশী। শেষমেশ প্রায় বারো-চৌদ্দ আনাই হয়ে ওঠে বোধ্য, অবোধ্য থাকে মাত্র দু-চার আনা; তা শব্দার্থ জানার অভাবে। পড়া চালাতে লাগলাম। ভাবলাম – থাক না কিছু অবোধ্য, যেটুকু বুঝি সেটুকুই লাভ।
ভূগোলে
এ সময় আমি আর ছবি অঙ্কন করি না। কিন্তু অঙ্কনের প্রবণতা ছাড়াতে পারিনি। এরই ফলে ভূগোল পড়তে গিয়ে মানচিত্র আঁকতে শুরু করে দিলাম। এ সময় একটা ঘটনা আমার মানচিত্র অঙ্কনের সুযোগ এনে দিল। ঘটনাটি এই-একদা রাত্রে পড়বার সময় আমার হাত থেকে “কুপী” বাতিটা বইয়ের উপর পড়ে গিয়ে কেরাসিন পড়ে বইয়ের কাগজ ভিজে গেল। এতে করে ভিজা কাগজের অপর পৃষ্ঠা বা তার নীচেকার কাগজের লেখাগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। আমি পরীক্ষা করে দেখলাম যে, কটু তেল বা নারিকেল তেলেও অনুরূপ ফল পাওয়া যায়। আমি নারিকেল তেল মাখানো কাগজ (শুকিয়ে) মানচিত্রের উপর রেখে নকল মানচিত্র আঁকতে শুরু করলাম।
কিছু দিন ভূগোল পাঠের সাথে সাথে মানচিত্র অঙ্কন করে আমি বোঝতে পারলাম যে, ভৌগলিক বিবরণ পড়ার সাথে সাথে মানচিত্র দেখার চেয়ে (মানচিত্র) অঙ্কনের গুরুত্ব বেশী। যেহেতু মানচিত্র – দর্শনের চেয়ে অঙ্কনে স্মৃতিপটে দাগ কাটে ভাল। আর কোন দেশ, প্রদেশ, শহর-বন্দর ইত্যাদি “স্থান” এর অবস্থান সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারনা না থাকলে ভূগোলের শুধু বিবরণ পড়ার কোন মূল্য থাকে না।
আমার অঙ্কিত মানচিত্রে কোন দেশ, প্রদেশ বা মহাদেশের সমস্ত শহর বন্দর চিহ্নিত করতাম না, করতাম প্রধান ও প্রসিদ্ধ গুলি। কেননা মূল মানচিত্রের সকল লেখা এক সময়ে নকল করতে গেলে আমার মানচিত্র হয়ে যেত একটা হিজি-বিজি ও মসিময়। বিশেষতঃ চিহ্নিত “স্থান” এর সংখ্যাধিক্যের দরুন উহা পঠনে ঘটত বিস্মৃতি। মানচিত্র আঁকবার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তেলাকাগজের ব্যবহার ত্যাগ করলাম। কিন্তু ওর দ্বারা আমি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, তার সুফল ভোগ করছি আজও (জরিপ কাজে)।
গণিত শিক্ষা
“গণিত পাঠ” বইখানা ধরে কয়েকদিন পাতা উল্টালাম। কিন্তু বেশী দূর এগুতে পারলাম না। কেননা বইখানা ছিল তখনকার “ছাত্রবৃত্তি” (ষষ্ঠ শ্রেণী) পড়ার পাঠ্য। আমার পক্ষে উহা ছিল সমুদ্র বিশেষ। সাতার দিলাম।
সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, বইখানায়ে অঙ্কের প্রত্যেকটি প্রক্রিয়ার প্রথমদিকে উহা কৰ্ষবার “নিয়ম” ও “উদাহরণ” দেয়া ছিল। আমি ধারাবাহিকভাবে নিবিষ্ট চিত্তে প্রত্যেকটি প্রক্রিয়ার “নিয়ম” পড়ে ও উদাহরণ” অনুসরণ করে অঙ্ক কষতে লাগলাম।
গণিত খানার “নিয়ম” ও “উদাহরণ” গুলো পেয়ে আমার শিক্ষকের আবশ্যকতা কমে গেল। কিন্তু বেড়ে গেল চিন্তার বহর। আবার সংসারের (বাড়ীর) নানা রূপ কর্ম-কোলাহল ও হৈহল্লাপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে একনিষ্ঠ চিন্তা-ভাবনা করাও অসম্ভব। তাই আমি অঙ্ক কষতে আরম্ভ করলাম গভীর রাতে, যখন থাকত না আমার নিবিষ্ট-চিন্তা-ভঙ্গকারী কোন শব্দ। মিশ্রামিশ্র চার নিয়ম হতে শুরু করে ভগ্নাংশ, দশমিক, সমানুপাত, ত্রৈরশিক, বর্গ ও ঘন ইত্যাদি যাবতীয় অঙ্ক ক’ষে বইখানা শেষ করতে আমার প্রায় দুবছর কেটে গেল।
১.০৬ আরবী শিক্ষায় উদ্যোগ (১৩২৬)
১৩২৬ সাল। এখন আমার বয়স প্রায় উনিশ বছর। পিতার মৃত্যুর পর দীর্ঘ পনরটি বছর বহু দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে মা আমাকে প্রতিপালন করছেন আর আমার দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছেন ও বলছেন – “আমার কুড় বড় হলে এক দিন সুখ হবে”। এখন আমি কিছুটা বড় হয়েছি। কিন্তু আমার দ্বারা মা’র কোন দুঃখ-কষ্ট লাঘব হচ্ছে না। এখনও আমাদের উভয়ের ভাতকাপড়ের চিন্তা মা-কেই করতে হচ্ছে। তবে আমি বড় হলাম কেন? কিন্তু এখন আমিই বা কি করতে পারি বা করব ভেবে পাচ্ছিলাম না।
বলছিলাম যে, আমাদের নীলামী জমিটুকু পুনঃ পত্তন আনা হয়েছে। কিন্তু তা নামে মাত্র। রায় বাবুদের দাবীর টাকা পরিশোধ করতে হয়েছিল সব জমিটুকু বন্ধক রেখে। এতে জমিতে আমাদের স্বত্ব এসেছিল কিন্তু দখল আসেনি।
মোল্লা সাব এ সময় বাউফল থানার পুলিশ। চাকুরীতে বেশ উপার্জন করেন। তিনি টাকা দিয়ে আমাদের বন্ধকী জমিটুকু ছাড়ালেন। মা আমাকে বল্লেন- “মোল্লার পোয় চাকরী করে, তুই হালুট কর। দুই জনে খাটলে আমাগো আর অভাব থাকবে না”। আমি সম্মত হলাম।
মোল্লা সাব পনর টাকা মূল্যে একটি হালের গরু কিনে দিলেন এবং প্রতিবেশী “এক গরুওয়ালা” একজন কৃষকের সহিত আমি ভাগে হাল-চাষ শুরু করলাম (কার্তিক-১৩২৬)। প্রথম ফসল জনালাম- খেসারী, মশুর, কিছু মরিচ ও তিল ইত্যাদি। কৃষি কাজ চালাতে লাগলাম।
এ সময় পর্যন্ত মাচানে প্রাপ্ত বস্তাটির বইগুলো পড়া আমার প্রায় শেষ হচ্ছিল (ব্যাকরণ বাদে)। এখন আমি প্রতিবেশী আঃ রহিম ফরাজীর নিকট গিয়ে পুথি পড়তে শুরু করলাম, অবশ্য রাত্রে। ফরাজী সাব সুর করে পুথি পড়তেন এবং আমি তার সাথে সাথে সুর মিলিয়ে কখনো বা একা একা পড়তাম। এরূপ বিভিন্ন পুথি পড়ে নানা রূপ কেচ্ছা-কাহিনী জ্ঞাত হয়ে আনন্দ পেতে লাগলাম। বিশেষতঃ এতে আমার (ভাষা) শিক্ষার অগ্রগতি হতে লাগল। অধিকন্তু – ছবি আঁকার মত আর একটা নেশায় আমাকে পেয়ে বসল। তা হ’ল – পুথির “পয়ার” ও “ত্রিপদী” জাতীয় ছন্দের অনুকরণে নূতন কিছু রচনা করা। চেষ্টা অব্যাহত রাখলাম।
আমাদের গ্রামে তখন “পুথিগান” এর প্রচলন ছিল যথেষ্ট। “পুথিপড়া” হতে “পুথিগান” ভিন্ন। ওকে “সায়েরগান” ও বলে। সায়েরগান অনেকটা কবি গানের অনুরূপ। এতে একজন বয়াতী ও দু-তিন জন দ্বোহার থাকে। পুথিগত কোন কেচ্ছা-কাহিনী কিংবা দেখা বা শোনা কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে বয়াতী গান রচনা করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে গানের মজলিসের কোন আশু ঘটনার প্রেক্ষিতে যখন তখন গান রচিত হইয়া থাকে। প্রত্যেকটি গানের দুটি অংশ থাকে “ধুয়া ও লহর” । “লহর” অংশটা বয়াতী একাই গেয়ে যায় আর “ধুয়া” অংশটা দ্বোহার গণ পুনরোক্তি করে। গানের “ধুয়া” অংশটা যারা পুনরোক্তি করে অর্থাৎ দ্বোহরায়, তাদের “দ্বোহার” বলা হয় এবং গান বা কবিতাদি অর্থাৎ “বয়াত” রচনাকারীকে বলা হয় “বয়াতী” |
আমাদের পাড়ায় ঐ রকম একজন পুথিগানের বয়াতী ছিলেন মেছের আলী সিকদার। ১৯১৪ সালের প্রথম মহাযুদ্ধে বৃটিশ সৈন্য দলে চাকুর নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন বসরায়। ১৯১৮ সালে যুদ্ধ বন্ধ হলে ১৯১৯ (বাং ১৩২৬) সালে অবসর প্রাপ্ত হয়ে তিনি বাড়ীতে এলেন এবং গ্রামের বিভিন্ন স্থানে আসর জমিয়ে পুথিগান গাইতে লাগলেন। যুব-বৃদ্ধ সকলেই গান শোনতে যেতেন, আমিও যেতাম। প্রথম কয়েকদিন গেলাম গানের শ্রোতা হিসেবে, পরে দ্বোহার হিসাবে।
সিকদার সাব যে সকল গান গাইতেন, আমি তার অনুকরণে গান রচনার চেষ্টা করতে লাগলাম এবং কয়েকটি গান রচনা করলাম। সিকদার সাবের গানের একজন দ্বোহার ছিলেন আমার প্রতিবেশী আঃ রহিম ফরাজী। আমার রচিত গান ক’টি তাকে দেখালাম এবং ধীরে ধীরে গেয়ে শোনালাম। শুনে তিনি বল্লেন- “হয়েছে ভাল, এগুলো আসরে গাওয়া চলে”। আমি আরো গান রচনা করতে লাগলাম।
১৩২৭ সালে আমি বয়াতী হয়ে পুথিগানের দল গঠন করলাম। আমার নেহার হলেন জাহান আলী, হোসেন মল্লিক ও আঃ রহিম খা। ওঁরা সকলেই আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাড়ার নিবাসী। দিন দিন গানের উৎকর্ষ হতে লাগল।
পুথিগান, প্রতিযোগিতা মূলক গান। এতে একাধিক বয়াতী না হলে গান ভাল জমে না। শ্রোতাগণ বিচার করেন যে, প্রতিযোগীদের মধ্যে কোন বয়াতীর-গলার স্বর, গানের সুর ও ছন্দঃ ভাল; কে অপেক্ষাকৃত অধিক তার্কিক, বাকপটু, শাস্ত্রজ্ঞ ইত্যাদি।
দেশী ও বিদেশী অনেক বয়াতীর সহিত আমার পাল্লার (প্রতিযোগিতার) গান হতে লাগল। এতে দেখা গেল যে, সব সময় তর্কযুদ্ধে জয়ী হতে হলে যে পরিমাণ শাস্ত্রজ্ঞান থাকা আবশ্যক, তা আমার নাই। কাজেই আমার আরো বেশী পরিমাণ পুস্তকাদি অধ্যয়ন করা আবশ্যক। সেজন্য সচেষ্ট হলাম।
এ সময় আমাদের সংসারের কর্তৃত্ব মা’র হাতে নেই, আমার হাতে। মোল্লা সব এসময় আমাদের পরিবারভুক্ত। তাই তিনি যে টাকা-পয়সা রোজগার করেন, তা আমার কাছে দেন এবং আমি উহা আবশ্যকীয় কাজে খরচ করি। হাতে নগদ পয়সা পেয়ে কিছু অযথা খরচ করতে লাগলাম, যাকে “সংসার খরচ” বলা চলে না। আলেপ-লায়লা, কাছাছোল আম্বিয়া, ফকির বিলাস, হযরতল ফেকা, তালে নামা, ছায়ত নামা ইত্যাদি কতগুলো পুথি এবং রামায়ন মহাভারত, মনসা মঙ্গল, গীতা, রাধাকৃষ্ণ বিলাস ইত্যাদি কতগুলো হিন্দু-শস্ত্র কিনলাম ও ওগুলো পড়তে লাগলাম।
রায় বাবুদের লামচরি তহশীল কাছাড়তে নীল কান্ত মুখাজী নামক একজন মোহরার ছিলেন, নিবাস পান বাড়ীয়া। তিনি ছিলেন হিন্দুশাস্ত্রে সুপন্ডিত। বিশেষতঃ সংস্কৃত ভাষা ভাল জানতেন। তার সাথে আলাপ-ব্যবহারে তিনি আমার বেশ বন্ধু হয়ে গেলেন। আমি তার ও পৌরাণিক গ্রন্থ দান করেন এবং ঋক বেদের কিছু অংশ বঙ্গানুবাদ করে দেন। “মনু সংহিতা” নামক বৈদিক গ্রন্থখানা দান করেন আমাকে চর মোনাই নিবাসী বাবু যামিনী কান্ত বিশ্বাস।
এ সময় আমি দিন ভর মাঠে কাজ করতাম আর রাত্রে – হয়ত কোথায়ও আসরে গান নচেৎ ঘরে বসে পুস্তকাদি অধ্যয়ন করতাম। সময়ের অপচয় করতাম না মোটেই। কৃষি ও গান, উভয়ের উন্নতি হতে লাগল। যে কোন বিষয় বা ঘটনা, দেখা বা শোনা মাত্র সে সম্বন্ধে তৎক্ষনাৎ গান রচনা করার ক্ষমতা আমার এ সময় অর্জিত হয়েছে।
মোল্লা সাব আমার বিবাহের জন্য উদ্যোগী হলেন এবং তার দোস্ত (বন্ধু) ময়জদিন গোলদারের একমাত্র কন্যা লালমন বিবির সহিত আমার বিবাহ স্থির করলেন। ১৩২৭ সালের ২২শে ফাল্গুন সরাজারী এবং ১৩২৯ সালের ২৯শে কার্তিক আমার শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল।
বিগত ১৩২৫ সালের অগ্রহায়ণ মাস হতে আমি নিয়মিত ভাবে সংসারের “জমা” ও “খরচ” এর হিসাব লিখে রাখতে শুরু করি। কেননা তৎপূর্বে আমার হাতে সংসারের কর্তৃত্ব ছিল না। মোল্লা সাব ট্রেনিং পাশ করে (ঐ সালে) কার্তিক মাসে বরিশাল এসে বাউফল থানায় বদলী হন এবং অগ্রহায়ণ মাস হতে সংসারের বাজার খরচ বাবদ আমার হাতে কিছু কিছু টাকা দিতে থাকেন। তিনি কখন, কত টাকা দিলেন এবং তা কিসে কত খরচ করলাম তা মোল্লা সাবকে বুঝায়ে দেওয়াই ছিল তখন জমা-খরচ লেখার উদ্দেশ্য। মোল্লা সাব সময় সময় হিসাব দেখতেন এবং বই পুথি কেনায় খরচ দেখলে অসন্তুষ্ট হতেন। এ জন্য এ যাবত আমি আমার আশানুরূপ পুস্তাকাদি কিনতে কুষ্ঠা বোধ করছি। বই-পুথি কেনা ও পড়া, এ দুটোই আমার যেন একটা নেশা। এ সময় আমার বই কেনার অসুবিধাটা দূর হল। কেননা এ সময় আমি পুথি গানে বেশ টাকা পেতে লাগলাম এবং তা সমস্তই খরচ করতে লাগলাম বই-পুথি কেনায় ।
১.০৭ চিকিৎসা শিক্ষা (১৩৩০)
১৩৩১ সাল। আমার জ্ঞাতি (চাচাত) ভ্রাতা আঃ রহিম (রহম আলী) মৃধা বেড়াতে যাবেন তাঁর বেহাই (মৃধা সাবের পুত্র ফজলুর রহমানের শ্বশুর) এমদাদ উল্লা কাজীর বাড়ীতে (কালীগঞ্জ)। মৃধা সাব ছিলেন- ধনে, মানে, জ্ঞানে, গুণে, এ অঞ্চলের সেরা ব্যক্তি। তিনি তার অনান্য কুটুম্ব ও সব জ্ঞাতি ভাইদের দাওয়াত করলেন এবং আমাকেও। অধিকন্তু আমাকে আমার গানের দ্বোহারগণকে নিয়ে যেতে বল্লেন। তিনি যাবেন সেখানে “পয়নামা” নিয়ে খুব ধুমধামের সহিত, সেখানে আমাকে গান করতে হবে। নির্দিষ্ট দিনে যথা সময়ে আমরা কাজী বাড়ী গেলাম এবং সবাই বৈঠকখানা ঘরে বসলাম। ঘরের মধ্যভাগটা -গেদী, বালিশ তাকিয়া ইত্যাদি নানা উপকরনে সাজানো। মৃধা সাব ও আমার অন্যান্য জ্ঞাতি ভাইয়েরা ওখানেই বসলেন। কিন্তু আমাকে বসতে দেওয়া হ’ল বারান্দায়। কারণ-আমি “বয়াতী”। গান করলাম। বাড়ীওয়ালা পুরষ্কার দিলেন দশ টাকা। কথায় বলে “যাক জান, থাক মান”। অর্থাৎ মানহানীর চেয়ে প্রাণহানী ভাল। আত্ম মর্যাদায় আঘাত পেয়ে সেদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম-বেঁচে থাকতে আর কখনো গান করব না, চেষ্টা করে দেখব কোনো দিন মৃধা সাবের পাশে বসতে পারি কি-না। (চেষ্টায় সফলতা লাভ করেছিলাম তখন, যখন১৩৩৯ সালে চর বাড়ীয়া ইউনিয়ন বোর্ডের প্রথম পদে নিবাচিত হলাম এবং ১৩৪৩ সালের নির্বাচনেও উভয়ে পুনঃ উহার “সদস্য” পদে নির্বাচিত হলাম। অধিকন্তু আমি হলাম নির্বাচিত “সহ সভাপতি” মৃধা সাব নন। এতদ্ভিন্ন -আমি তার সামনেই সরকার কর্তৃক মনোনিত হয়েছিলাম ১৩৪৬ সালে স্থানীয় ডি, এস বোর্ডের “সদস্য” এবং ১৩৪৮ সালে চর বাড়ীয়া ইউনিয়ন জুট কমিটির “সহ সভাপতি”।)
১.০৮ জীবন প্রবাহের গতি (১৩৩১)
বরিশাল চকের পোলের পূর্ব পাশে ঢাকা নিবাসী মুন্সি আলীমুদিন সাবের একখানা পুস্তকের দোকান ছিল। তিনি তাঁর দোকানে- কোরান শরীফ, কেতাব ও পুথিই রাখতেন বেশী; কিছু বাংলা বইও রাখতেন। আমি ওখানে যাতায়াত করে মুন্সি সাবের সাথে ভাব জমালাম এবং সুযোগ মত ওখানে গিয়ে বই-পুথি পড়তে লাগলাম। একদা মুন্সি সাব আমাকে “রবিনশন ক্রুশো” নামক এক খানা বই দিলেন, আমি ওখান কিনে আনলাম। নিঃসঙ্গ ও নিঃসম্বল রবিনশন বহু বছর যাবত দ্বীপবাসী থেকে কিভাবে বেঁচে থাকছিলেন, সে কাহিনী পড়ে আমার এক নুতন মানসিকতার সৃষ্টি হল। আমি ওতে দেখলাম-“মানুষের অসাধ্য কাজ নাই, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, সাহসে শক্তি যোগায়” ইত্যাদি বহু প্রবাদ বচনের প্রত্যক্ষ উদাহরণ আমাকে স্বাবলম্বী হবার প্রেরণা। ওটা আমার স্মরণীয় হয়ে আছে ও থাকবে।
আমার জীবন প্রবাহের গতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সম্ভবতঃ চারজন লোকের দ্বারা। তাঁরা হচ্ছেন (১) মাষ্টার এমদাদ আলী, (২) মোল্লা আঃ হামিদ (৩) মুন্সি আলী মুদিন এবং অধ্যাপক (৪) কাজী গোলাম কাদির-সাব। এর যে কোনো একজন লোকের অভাবে আমার জীবনের গতি হয়ত অন্য দিকে চলে যেত (১) মাষ্টার এমদাদ আলী সাব আমার উপকার-না-অপকার করেছে, জানি না, তবে তিনি আমার “ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্কল্পে বাধাদান” করে আমার জীবন প্রবাহকে বিপরীত মুখী করেছেন, বের করে দিয়েছেন আমাকে আলেম সমাজ হতে। (২) আমাকে আধুনিক শিক্ষার পথ প্রদর্শন ও শিক্ষা লোভী করেছেন মোল্লা সাবের”বইয়ের বস্তাটি”। ওটা না পেলে আমি জ্ঞান রাজ্যের পথের সন্ধান পেতাম না, হয়ত চলে যেতাম অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের রাজ্যে, হয়ে পড়তাম কু-সংস্কারের বেড়া জালে আবদ্ধ। (৩) মুন্সি আলী মুদিন সাবের প্রদত্ত “রবিনশন ক্রুশো” বই খানা দিয়েছে আমাকে স্বাবলম্বী হবার প্রেরণা, অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে, উচু-নীচু সর্বস্তরের সকল কাজ স্বহস্তে করবার উদ্দীপনা। ও বইটাই আমার যাবতীয় “চেষ্টা” ও সাহস এর উৎসওটা না পেলে হয়ত আমি হয়ে যেতামঅলস, অক্ষম ও পরাধীন, অর্থাৎ অন্যের হাতের ক্রীড়া-পুত্তলী। ১৩২৩ সালে মায়ের বাসা ঘরটি ভেঙ্গে মোল্লা সাব সেখানে (১০ X ৫ হাত) এক খানা কুঁড়ে ঘর তুলেছিলেন।
১.০৯ ছুতার কাজ শিক্ষা (১৩৩১)
এ যাবত আমরা ওতেই বসবাস করছি। কিন্তু এখন আর ওতে চলছে না। বিগত ৩/৯/২৯ (বাং) তারিখে স্থানীয় আয়শা বিবির নিকট হতে কিছু জমি কিনেছি এবং বাড়ীর পূর্বদিকে চর পড়িয়া কিছু জমি বৃদ্ধি হয়েছে। এতে কৃষি কাজের কিছু উন্নতি হচ্ছে ও পশার বাড়ছে। ধান, চাল, পাট, তিল, মরিচ ইত্যাদি নানা ফসলের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে বর্তমান কুঁড়ে ঘরখানা এখন অনুপযোগী। ভাবলাম – ছোটখাট একখানা টিনের ঘর তুলব। কিন্তু ছুতার লাগাব না, কাজ সব করব নিজে।
আমাদের ঘরে বহুবছর যাবত একটি হাতুর ও একটি বাটালী ছিল। ওদুটো সংগ্রহ করছিলেন মোল্লা সাব। আমি বরাবরই ওর দ্বারা কাঠকুটাে কাটাকুটি করতাম। গৃহ নির্মাণের জন্য আরো যে সব হাতিয়ার আবশ্যক, তা চাইলাম প্রতিবেশী আঃ কাদির আকনের কাছে, তিনি দিতে সম্মত হলেন। আকন সাব ছিলেন একজন সুনিপুণ ছুতার মিস্ত্রী, তবে পেশাদার নহেন।
একদা চর মোনাই নিবাসী কাজেম আলী হাওলাদারের একখানা ঘর দেখে আমার খুব ভাল লাগছিল। তখন ভাবছিলাম যে, কখনো পারলে এই রকম একখানা ঘর তুলব। সেখানে গিয়ে সেই ঘরখানার একটা নক্সা এঁকে ও তার বিভিন্ন অংশের মাপ ঝোক লেখে আনলাম।
বরিশাল হতে কিনে আনলাম- শাল কাঠের খাম ও বাইন কাঠের আড়া, পাইর, রুয়া, চেড়া ইত্যাদি এবং টিন তক্তাদি ঘরের আবশ্যকীয় কাঠ সংগ্রহ করছিলাম একটা খরিদা কড়ই গাছ চিড়িয়ে।
১৩৩১ সালের ১১ই কার্তিক, আমাদের পুরান খড়ের ঘরখানা ভেঙ্গে (১৩ X ১০ হাত) নুতন ঘরের খাম পুতলাম এবং যথা নিয়মে কাজ করতে লাগলাম। খাম পুতিয়ে আড়া-পাইর লাগিয়ে, চাল বানিয়ে ছাউনী দিতে প্রায় মাস দেড়েক কেটে গেল।
২৫শে অগ্রহায়ণ নতুন ঘর সঞ্চার করলাম (নতুন বেড়া বাকি)। অতঃপর মাঠের কাজের ফাকে ফঁাকে ত্রিকাঠ, চৌকাঠ, বেড়া, কবাট, জানালা ইত্যাদি তৈরী করতে বছর খানেক কেটে গেল এবং গৃহ সরঞ্জাম যথা- খাট, চেয়ার, টেবিল, বাক্স, আলমারী ইত্যাদি তৈরী করতে সময় লাগল আরো বছর খানেক। অতঃপর আমার যখন যেটুকু ছুতারের কাজ আবশ্যক হতে থাকল, তখন তা নিজেই করতে লাগলাম।
(১৩৩৪ সালে মোল্লা সাব আমাকে -করাত, বুরুম, রেদা, সারাশী, ভ্যানা, মাতুল, কুরুল ইত্যাদি ছুতার কাজের যাবতীয় যন্ত্রপাতি কিনে দিলেন এবং ওর বিনিময়ে আমি তার এক খানা (১৩ X ১০ হাত) নুতন টিনের ঘর তুলে দিলাম (মোল্লা সাব আমার সংসার হতে ১৩৩২ সালের ১০ই আষাঢ় ভিন্ন হচ্ছিলেন।)
এ সময় হতে ছুতার কাজের যন্ত্রপাতি সমূহ হল আমার নিজস্ব। তাই পরবর্তি জীবনের যাবতীয় গৃহ ও গৃহসরঞ্জামাদি নিজেই তৈরী করেছি ও করছি, এমন কি লাঙ্গল-জোয়াল এবং নৌকাও। আমার সংসার জীবনে কখনো কোন কাজ “জানিনে” বলে অন্যের শরণাপন্ন হইনি। অথচ অর্থ-উপার্জনের জন্য কখনো অন্যের কোন কাজ করিনি। আমার ছুতার কাজ শিক্ষার উদ্দেশ্য হল-অর্থে পার্জন বা অর্থ বাচানো নয়, স্বাবলম্বী হওয়া। ফলতঃ যে কোন ধরনের কাজ – “করতে জানা” এবং তা “নিজ হাতে করা”, এ দুটোতেই আমার মনের আনন্দ। রশি পাকানো, শিশি-বোতলের গলে “যোত” লাগানো এমন কি ঝাটা নির্মাণকেও আমি গৌরবের কাজ মনে করি।
১.১০ জরীপ কাজ শিক্ষা (১৩৩৩)
১৩৩৩ সাল। একদা মোল্লা সাব এক বান্ডিল কাগজ আমার হাতে দিয়ে বল্লেন- “এইগুলি সারিয়া রাখিও”। ওর ভেতর ছিল- বন্দকী জমি ছাড়ানো কয়েকখানা ছেড়া দলিল, লামচরি মৌজার সি,এস ম্যাপ, পর্চা, দাখিলা, রশিদ ইত্যাদি ভূসম্পত্তি বিষয়ক কাগজপত্র। ওগুলো পড়ে দেখলাম, সব বোঝলাম না। তবে ম্যাপখানা নিয়ে বিশেষভাবে চেষ্টা করতে লাগলাম উহা ভালভাবে বোঝবার জন্য। কেননা আমার ভৌগলিক মানচিত্রগুলো আকবার ও দেখবার উৎসাহটা গড়ায়ে পড়ল এটার ওপর। ম্যাপখানা ছিল- ২০২৯ নং মৌজা চর বাড়ীয়া লামচরির ২ নং সিট। স্কেল ১৬”= ১ মাইল। এটাতে আমাদের বাড়ী, বাগান, পুকুরাদি ও নাল জমি অঙ্কিত আছে এবং খাল-নদীও । আমার পিতার নামের পর্চায় লিখিত দাগ-নম্বর সমূহ ম্যাপে মিলিয়ে দেখলাম যে, আমাদের জমি কোন কোনটা।
ভূগোলের মানচিত্রগুলোতে দেখেছি যে, এক ইঞ্জির সমান- ৫০, ৬০ কিংবা ৪০০, ৫০০ মাইল; আর সি.এস ম্যাপ খানা ষোল ইঞ্জির সমান এক মাইল। অর্থাৎ এক ইঞ্চির সমান মাত্র ১১০ গজ বা ২২০ হাত। অনেক সময় ভূগোলের মানচিত্র গুলোতে অঙ্কিত বিভিন্ন স্থানের দূরত্ব মেপে দেখার ইচ্ছে হত, কিন্তু সে মাপ বাস্তব ক্ষেত্রের সাথে একরূপ হল কি-না, তা যাচাই করবার উপায় ছিল না। যেমন-বরিশাল হতে কলকাতা অথবা ঢাকা হতে করাচীর দূরত্ব মানচিত্রে মাপা গেলেও ভূপৃষ্ঠ মেপে ওর সত্যতা প্রমান করা সম্ভব নয়। কোন গ্রাম বা ৬ মৌজার সি, এস মানচিত্রে ওরূপ অসুবিধা নেই। কেননা এর পরিধি তত বড় নয়। সি, এস ৩ মানচিত্রের দুটি স্থানের দূরত্ব মেপে, তা সরেজমিনে যাচাই করে দেখতে আমার কৌতুহল হল।
সি,এস ম্যাপ খানার এক জায়গায় একটা স্কেল অঙ্কিত দেখতে পেলাম। ওতে একটা ইঞ্চি ছিল পাঁচ ভাগে বিভক্ত। অর্থাৎ প্রত্যেক ভাগের মান ছিল ২২ গজ বা ৪৪ হাত, অতি সাদা সিধে ধরনের স্থল স্কেল। দেখলাম যে, এতে মাপ চলে না। এক ইঞ্চিকে চল্লিশ ভাগে বিভক্ত করে আমি পীজ বোড কাগজ দ্বারা একখানা স্কেল বানালাম। এর প্রত্যেক ভাগের মান হ’ল ৫.৫ হাত। আর বানালাম -১৮” হাতের ৫.৫ হাত দৈর্ঘ্য একট নল। ডিভাইডার বা কাঁটা বানালাম টিন দিয়ে। প্রায় ৫” ইঞ্চি লম্বা দুখানা টিন- এক দিক স্থল ও একদিক সুক্ষ্ম করে কেটে, উভয়ের স্কুলাংশ একত্র করে একটা খিল মেরে এঁটে দিলাম। এতে কাজ চলার মত একটা ডিভাইডার তৈরী হ’ল। এভাবে জরিপী সরঞ্জাম সংগ্রহ করে একদিন ম্যাপ নিয়ে মাঠে নামলাম ।
মনে পড়ে তখন মাঘ মাস। আমার বাড়ীর পূর্ব পাশের জমিটা মাপতে শুরু করলাম। জমিটা আমার, সি, এস ম্যাপের ১৩৩১ নং দাগ। জমির একটা আলের উভয় প্রান্তে কাটা ধরে, উহা স্কেলে ফেলে দেখতে লাগলাম যে, ওতে স্কেলের কাটা পূরো ইঞ্চি বা কটা ক্ষুদ্রাংশ পড়ল। অতঃপর -প্রতি এক ইঞ্চির সমান ২২০ হাত এবং প্রতি এক ক্ষুদ্রাংশের সমান ৫.৫ হাত ধরে হিসেব কষে বের করতে লাগলাম যে, আলটি লম্বায় কত নল বা হাত হ’ল। তৎপর সরেজমীন পরিমাপ। এ ভাবে জমিটার সব ক’টি আ’লই জরিপ করা হল। কিন্তু ম্যাপের হিসাবও সরে জমিনের পরিমাপ একরূপ হ’ল না, কিছু বেশী বা কম দেখা গেল। আমি মনে করলাম যে, ওসব হয়ত আমার হিসাবের ভুল, নচেৎ কাঁটা ধরার দোষ। যা হোক, মাঠের কাজের ফাকে ফাঁকে জমি জরিপ করতে লাগলাম। কিন্তু কোন লোকজন সাথে নিয়ে নয়, একা একা।
তখন দক্ষিণ লামচরি তোরাপ আলী আকনজী ছিলেন একজন সুদক্ষ আমিন। আমি আমার জরিপ কাজের ইচ্ছা ও কায়দা সমূহ তাকে জানালে, তিনি বল্লেন যে, ওভাবে হিসেব কষে কষে জরিপ কাজ করা সম্ভব নয়, ওর জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা আছে। সেটেলমেন্টের ম্যাপ-দ্বারা “হাত” এ জরিপ করতে হলে তার জন্য বিঘা-কাঠার স্কেল ও শিকল ব্যবহার করতে হয়। তিনি আরো বল্লেন যে, তার একটা বিঘা-কাঠার স্কেল আছে, তিনি এখন আর ওটা ব্যবহার করেন না। কাজেই ওটা আমাকে দিতে পারেন এবং তার শিকলটাও দিতে পারেন কিছু দিনের জন্য । আমি তার স্কেল ও শিকল নিয়ে এলাম। পরে বরিশাল হতে লোহার মোটা তার কিনে এনে আকনজী সাবের শিকল দেখে ও মেপে তার কেটে কেটে কড়ি ও আংটি বানিয়ে ২৪ বিঘা অর্থাৎ ২০ হাত দৈর্ঘ্য এক গাছা শিকল তৈরী করে আকনজী সাবের শিকল ফেরত দিলাম।
স্কেল ও শিকল ব্যবহারের ফলে জরিপ কাজে আমার কিছুটা আত্মবিশ্বাস জনিল। অনেক জমি জরিপ করে দেখতে পেলাম যে, কোন জমির-ম্যাপের মাপে ও দখলের মাপে যে ব্যতিক্রম দেখা যায়, তা অনেক ক্ষেত্রেই দখলের ভুলের জন্য। সে ভুল শোধরানোটাই হ’ল আমিনের কাজ।
“আমিন” হিসেবে আমার দ্বারা প্রথম জমি জরিপ করালেন আমার প্রতিবেশী ও জ্ঞাতি চাচা মহব্বত আলী মাতুব্বর সাব। জমিটা তার বাড়ীর পূর্ব পাশে- সি, এস ম্যাপের ১৩৩৪১৩৪০ নং দাগ। আমাকে বারবরদারী দিলেন এক টাকা।
এতদঞ্চলে জমি জরিপ কাজের দুটি প্রথা আছে-দেশী ও বিদেশী। দেশী প্রথায় জমি জরিপ করা হয়-হাত বা নলে ও পরিমাপকে বলা হয়-বিঘা, কাঠা বা কানি, কড়া ইত্যাদি এবং বিদেশী (ব্রিটিশীয়) প্রথায় জরিপ করা হয়-লিঙ্ক বা চেইনে আর পরিমানকে বলা হয়-একর বা শতাংশ বিদেশী প্রথায় জরিপ কাজে গান্টারের চেইন ও স্কেল ব্যবহার করতে হয়, প্রথম আমার তা ছিল না। এমন কি জানাও ছিল না | আমি অতি সহজ ভাবে দেশী প্রথায় জরিপ কাজ শুরু করি। কিন্তু এ প্রথায় নানাবিধ অসুবিধা ভোগ করতে হয়। তাই বিদেশী অর্থাৎ আধুনিকী জরিপ পদ্ধতি শিক্ষায় উদ্যোগী হই।
১৩৫৩ সালের পৌষ মাসে লাহারাজ স্টেটের সার্ভে সুপারভাইজার বাবু বিজয় গোপাল বসু মহাশয় আমাদের গ্রামের পূর্ব পার্শ্বস্থ প্রতাপপুর মৌজা জরিপ করতে আসেন এবং বহুদিন যাবত এখানে জরিপ কাজ করেন। সে সময় আমি তার সহকারী রূপে কাজ করি এবং জরিপ বিষয়ক নানাবিধ যন্ত্রপাতি যথা-নর্থ-কম্পাস, প্রিজমেটিক কম্পাস, সাইড ভ্যান, রাইট এ্যাঙ্গেল ইত্যাদির ব্যবহার পদ্ধতি শিক্ষা করে লই।
বরিশালের “ফরিয়া পট্টি” নিবাসী বাবু ললিত মোহন সাহা ১৩৫৪ সালে আমাকে একটি গাটারের চেইন উপহার দেন এবং স্থানীয় কাছেম আলী (পিং করিমদিন) প্রদান করেনপ্রতাপপুর মৌজায় পড়ে পাওয়া একটি (পিতলের) গান্টারের স্কেল। এ সময় হতেই আমি বিদেশীয় প্রথায় জরিপ কাজ শুরু করি। কিন্তু জরিপ কাজের অন্যান্য যন্ত্রপাতির অভাবে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারছিলাম না।
১৩৫৫ সালে স্থানীয় আমিন তোরাপ আলী আকনজী তার কর্মজীবনের শেষ মুহুর্তে তার ব্যবহার্য প্লেন টেবিল ও সাইড ভ্যানটি আমাকে দান করে যান। ১৩৫৬ সালে দক্ষিণ লামচরি নিবাসী নজর আলী (পিং বাছেরদিন) দক্ষিণের চরে পড়ে পাওয়া একটি (নিকেলের) ড্রাইভার প্রদান করেন। জমিদার উচ্ছেদ হলে ১৩৬৪ সালে লাখুটিয়ার জমিদার মিঃ পরেশ লাল রায়ের (ঘুঘুবাবুর) তৎকালীন ম্যানেজার বাবু অনন্ত কুমার বসু মহাশয় তাদের অনাবশ্যক বিধায়| আমাকে প্রদান করেন- একটি নর্থ কম্পাস, একটি প্রিজম্যাটিক কম্পাস, চারটি রাইট এ্যাঙ্গেল ও একটি অপটিক্যাল স্কোয়ার। এর পর হতে কোন যন্ত্রপাতির অভাব না থাকায় আমি সুষ্ঠুভাবে জরিপ কাজ করতে সক্ষম হচ্ছি।
জরিপের বেশীর ভাগ কাজই হ’ল জমির সীমানা নির্ধারণ ও বাটারা করা। কিন্তু আমাকে মানচিত্র অঙ্কনের কাজ করতে হচ্ছে যথেষ্ট। এর মধ্যে আমার প্রধান দুটি কাজ হ’ল- ১৩৬৯ সালে চর বাড়ীয়া ইউনিয়নের ম্যাপ অঙ্কন ও ১৩৭৪ সালে চর মোনাই ইউনিয়নের ম্যাপ অঙ্কন করা। এর পারিশ্রমিক প্রাপ্ত হয়েছি যথাক্রমে- ২০০.০০ ও ১৮৭.০০ টাকা।
জরিপ কাজে শুরু হতে আমার বারবরদার (ভিজিট) ছিল নিম্নরূপঃ
১৩৩৩ সাল হতে ১৩৪৫ সাল পর্যন্ত (খোরাকী বাদ) দৈনিক ১.০০ টাকা
১৩৪৬ সাল হতে ১৩৫৩ সাল পর্যন্ত (খোরাকী বাদ) দৈনিক ২.০০ টাকা
১৩৫৪ সাল হতে ১৩৫৫ সাল পর্যন্ত (খোরাকী বাদ) দৈনিক ৫.০০ টাকা।
১৩৫৬ সাল হতে ১৩৫৭ সাল পর্যন্ত (খোরাকী বাদ) দৈনিক ৬.০০ টাকা
১৩৫৮ সাল হতে ১৩৭৭ সাল পর্যন্ত (খোরাকী বাদ) দৈনিক ৮.০০ টাকা
১৩৭৮ সাল হতে (খোরাকী বাদ) দৈনিক ১০.০০ টাকা
১৩৭৯ সাল হতে (খোরাকী বাদ) দৈনিক ১৬.০০ টাকা
১৩৮০ সাল হতে (খোরাকী বাদ) দৈনিক ২০.০০ টাকা
১৩৮১ সাল হ’তে (খোরাকী বাদ) দৈনিক ৩০.০০ টাকা
(জরিপ শিক্ষা বিষয়ক কোন বই পুস্তক পাঠের সৌভাগ্য আমার কখনো হয়নি।)