মোল্লা সাব রাত ৮টায় বাড়ীতে এসে আমাকে দেখতে পেয়ে খুশী হলেন কি-না, জানি না; তবে নিশ্চিন্ত হলেন। পরের দিন আবার তিনি থানায় গেলেন (বরিশাল) আমার “পোঁছার” সংবাদ পুলিশে জানাবার জন্য। রাত্রে তিনি বাড়ীতে এসে বল্লেন যে, সে পুলিশের “কনেষ্টবল” পদে ভর্তি হয়ে এসেছেন। আসছে বৈশাখ মাসের মধ্যভাগে তিনি ট্রেনিং এ যাবেন। যথা সময়ে মোল্লা সাব ছয়মাস ট্রেনিং এর জন্য ঢাকায় গেলেন। আমি শ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম। (বৈশাখ ১৩২৫)
ভাবতে লাগলাম-এখন কি করব। প্রতিজ্ঞা করেছি-“হয়ত পড়ব নয়ত মরব”। প্রতিজ্ঞা বহাল রাখতে হলে আমাকে পড়তে হবে, নচেৎ মরতে হবে। কিন্তু কোথায়ও পড়বার সুযোগ পাচ্ছি না বলে কি মরব? মরা ত সোজা কথা নয়। কেমন করে মরব। আত্নহত্যা ইচ্ছা-মৃত্যু চেষ্টা সাপেক্ষ। স্বেচ্ছায় মরতে হলে তার জন্য চেষ্টা করতে হবে। মরার জন্য যেমন চেষ্টা আবশ্যক, তেমন পড়ার জন্যও। তবে কোনটা আগে করব? স্থির করলাম যে, আগে পড়বার জন্য চেষ্টা করব, বিফল হলে পরে মরবার চেষ্টা।
এখন সমস্যা হল- কোথায় পড়ব? কার কাছে পড়ব? কি পড়ব? ইত্যাদি। সমাধান করলাম-আমি কোথায়ও পড়ব না, কারও নিকট পড়ব না, একটা কিছু পড়ব না। আমি ঘরে বসে পড়ব, একা একা পড়ব, সব কিছু পড়ব; অর্থাৎ যা-ই-পাব, তা-ই-পড়ব।
১.০৫ মুন্সি আপছার উদ্দিন (১৩২৫)
দক্ষিণ লামচরি নিবাসী পূর্বোক্ত কাজেম আলী সরদার সাব (তাঁর জামাতা) মুন্সি আপছার উদ্দিন নামক এক জন আলেম এনে তাঁর বাড়ীতে পুনঃ মক্তব খোল্লেন। মুন্সি সাব বাংলা ভাষা ভাল জানতেন না, তবে আরবী, ফারসী ও উর্দুতে ছিলেন সুপণ্ডিত এবং সুফিও। তার মত নিষ্ঠাবান নিষ্কাম সাধু পুরুষ আলেম সমাজে অল্পই আছেন। আমি তার মক্তবে ভর্তি হলাম না, তবে সকাল-সন্ধ্যায় তার কাছে গিয়ে আরবী ও উর্দু পড়তে শুরু করলাম (১৩২৫ সালের বৈশাখ মাসের শেষ ভাগ হতে) এবং পড়লাম-পবিত্র কোরান, রাহে নাজাত ও মেফ তাহুল জান্নাত নামক দুখানা কেতাব। নামাজদি দীনিয়াতের অত্যাবশ্যকীয় বিষয় সমূহ তার কাছেই শিক্ষা করলাম।
আমার ভাগ্যবিপর্যয় ঘটেছিল পিতার মৃত্যুর পর হতেই। কিন্তু উহা চরমে পুছেছিল ১৩১৭ সালে, বিত্ত নীলামের পর। রায় বাবুরা আমার চাষের জমিটুকু সবই নীলামে খরিদ করে দখলে নিয়েছিলেন। কিন্তু ভিটি-বাড়ীটুকু দখল করে নিচ্ছিলেন না। আর আমাদের সম্বলও ছিল উহাই। ওর মধ্যে বেড়-পুকুর ও ঘরভিটি বাদ গিয়ে . . . কাঠার বেশী জমি ছিল না। ওতে কয়েকটি ফলবান নারিকেল ও সুপার গাছ ছিল, যার ফল বিক্রি করা যেত। এ ছাড়া বাড়ীতে মা – লাউ, কুমড়া, চিচিঙ্গা ইত্যাদি তরিতরকারী ও মরিচ রোপন করে ও সব বিক্রি করে কিছু পয়সা পেতেন। এতদ্ভিন্ন মাও ধাত্রী কাজে কিছু পেতেন। এছাড়া হাস-মোরগ পালন ছিল আর একটি আয়ের পথ। আর এর দ্বারা নির্বাহ করতে হত দুটি প্রাণীর বারো মাসের খোরাক, পোষাক ও অন্যান্য খরচ পত্র।
আত্নীয় কুটুম্বরা কেহ কোনরূপ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন নি। দেখেছি অভাব গ্রস্ত ব্যক্তির নিকট হতে –
“আত্মীয় কুটুম্ব সব দূরে সরে যায় কেননা নিকটে পেলে যদি কিছু চায়?” কিন্তু আমাদের তুচ্ছ করে সরে যায়নি মাত্র দুজন, তারা হ’ল – “উপবাস” ও “ছিন্নবাস”।
বই ও পুথি প্রাপ্তি
আমাকে পড়া-লেখা শেখায়ে মানুষ করবার আন্তরিক ইচ্ছা মা’র ছিল, কিন্তু তার সামর্থেও কুলোয়নি।
আমার মনে বড় রকমের একটা আফসোস ছিল এই যে, তখনো আমি বাংলাভাষা স্বচ্ছন্দে পড়তে পারতাম না, অনেক শব্দই বর্ণবিন্যাস করে পড়তে হত। এতে যে কোন একটি বাক্য অবিরাম না পড়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়বার ফলে ওর অর্থ দুর্বোধ্য হত। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলাম বাংলা ভাষা স্বচ্ছন্দে পড়বার জন্য।
বই কেনার সম্বল নেই বলে এপাড়া ওপাড়ার ছেলেদের পরিত্যক্ত ছেড়া বই সংগ্রহ করে পড়তে লাগলাম, পড়তে লাগলাম – পথে পড়ে থাকা টুকরো কাগজ কুড়িয়ে, এমন কি লবণ বাধা ঠোঙ্গার কাগজও। কোন রূপ লেখা থাকলেই তা হ’ত আমার পাঠ্য। ওতে কি লেখা, কোন বিষয় লেখা, উহা পাঠে কোন জ্ঞানলাভ হ’ল কি-না ইত্যাদি প্রশ্ন ছিল আমার অনাবশ্যক। তখনকার আমার পড়ার উদ্দেশ্য ছিল শুধু – স্বচ্ছন্দে পড়বার ক্ষমতা অর্জন করা।
এ সময় বই ছিল আমার নিত্য সহচর। ঘরে বসে পড়তাম, শুয়ে পড়তাম, খাবার সময় পাশে বই মেলে রেখে খেতাম ও পড়তাম। কোথায়ও ভ্রমনে বের হলে সঙ্গে বই নিয়ে যেতাম এবং কোন আত্মীয়ের বাড়ীতে বেড়াতে গেলেও কোনও না কোন বই সঙ্গে নিয়ে যেতাম আর সুযোগ মত পড়তাম। অনেক সময় “স্বচ্ছন্দে বই পড়ছি”, ইহা স্বপ্নে দেখতাম।
একদিন আমাদের ঘরের মাচানের ওপর কাপড়ে বাধা একটা কাগজের বস্তা দেখতে পেলাম। ওটা-কবে, কোথা থেকে কে এনেছে- তা জানি না; তবে ওখানে রেখেছেন মোল্লা সাব। বস্তাটি নামিয়ে খুলে দেখতে পেলাম যে, ওর ভেতর আছে – কতগুলো বই, পুথি ও হাতের লেখা খাতা। বই গুলোর মধ্যে আছে – একখানা “গণিত পাঠ” একখানা “ভূগোল শিক্ষা প্রণালী”, একখানা “ভারত বর্ষের ইতিহাস”, একখানা “সরল বাংলা ব্যাকরণ” ও একখানা গল্পগ্রন্থ “গোপাল ভাড়” । পুথি গুলোর মধ্যে আছে সোনাভান, জঙ্গনামা, মোক্তল হোসেন, আছরাচ্ছালাত, গাজী কালু, রসনেছা মালু খাঁ ইত্যাদি এবং খাতাগুলোর মধ্যে আছে কতগুলো তন্ত্ৰ-মন্ত্র ও তাবীজ-কবজের নমুনা। বই-পুথি গুলো পেয়ে তখন আমি যে আনন্দ লাভ করেছিলাম, তা আজও ফুরোয় নি। ওগুলোর জন্যে মোল্লা সাবকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করব আজীবন। তখন মনে মনে ভাবলাম যে, পেটের খোরাক পাই আর না পাই মনের খোরাক পেলাম বহুদিনের। আপাততঃ আমার বই-পুস্তকের অভাব দূর হল, এখন অপেক্ষা শুধু পড়বার। দেখা যাক।