————–
(১) এর পর মুন্সি সাব ফরমায়েস দিলেন যে, একখানা “বাল্য শিক্ষা” বই কিনতে হবে। মাকে উহা জানালে তিনি আগের মতই উত্তর দেন “পয়সা কই ?”
এতদিন পর মূল্যটা ঠিক স্মরণ নাই তবে রামসুন্দর বসু প্রণীত একখানা “বাল্য শিক্ষা” ও একখানা “ধারাপাত” বই কিনে দিলেন আমাকে আমার ভগ্নিপতি মরহুম আঃ হামিদ মোল্লা এবং মুন্সি সা’ব স্বয়ং সংগ্রহ করে দিলেন আরবী কায়দা সম্বলিত একখানা “আমপারা”। এ সময় আমি পড়তে লাগলাম “বাল্য শিক্ষা” বই ও “আমপারা” এবং লেখতে লাগলাম “শতকিয়া-কড়াকিয়া” আর কষতে লাগলাম “যোগ-বিয়োগাদি (অমিশ্র) অঙ্ক”।
(২) এটা হলো আমার শিক্ষা-জীবনের তৃতীয় বছর অর্থাৎ ১৩২১ সাল। আমাদের গ্রামের প্রায় সমস্ত লোকই ছিলেন বিত্তবান। কিন্তু শিক্ষার প্রতি ছিলেন উদাসীন। তাই কেউই রীতিমত মুন্সি সাবকে ছাত্র বেতন দিতেন না। মুন্সি সাবও ঘরের খেয়ে পরের গেয়ে সময় নষ্ট না করে মক্তবটি বন্ধ করে দিলেন। আর এখানেই হলো-“বাল্য শিক্ষা” বই পড়ে আমার বাল্য-শিক্ষার সমাপ্তি বা সমাধি।
১.০২ ছবি ও জলের কল (১৩২২)
মক্তবটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সকালে-বিকেলে দীর্ঘ লাফ ও দুপুরে-খালের জলে ডুব-সাঁতার ইত্যাদি খেলা-ধুলা নিত্যকার কাজ হয়ে দাঁড়াল এ পাড়ার সব ছেলেদের এবং আমারও। কিন্তু এতদ্ভিন্ন আরও দুটি কাজের প্রবণতা ছিল আমার। যাহা অন্য কোন ছেলের ছিল না। সে কাজ দুটি হলো-ছবি আঁকা ও জলের কল তৈরী করা কেন, জানি না, আমি ছবি ভাল বাসতাম। “বাল্য শিক্ষা” ও অন্যান্য বইয়ের পাতা উল্টিয়ে আমি উহা বার বার দেখতাম এবং ওগুলি নিজ হাতে আঁকিবার নিষ্ফল চেষ্টা করতাম।
এ সময় (১৩২২ সাল) বরিশালে “জলের কল” স্থাপিত হতেছিল। বরিশালে যাতায়াতের পথে আমি উহা মনোযোগের সহিত দেখতাম ও দেখে আনন্দ পেতাম এবং বাড়ীতে এসে কৃত্রিম “জলের কল” তৈয়ার করতাম।
১.০৩ মুন্সি আহাম্মদ দেওয়ান (১৩২৩)
১৩২৩ সালে আমার জ্ঞাতি চাচা মহব্বত আলী মাতুব্বর সা’ব আহাম্মদ আলী দেওয়ান নামক ভাসান চর নিবাসী এক জন মুন্সি রেখে তার বাড়ীতে একটি মক্তব খোলেন। আমি ঐ মক্তবে ভর্তি হলাম। এখানে আমার পাঠ্য ছিল “মক্তব প্রাইমারি” নামক একখানা বই এবং গণিতে করণীয় ছিল মিশ্র চার নিয়মের অঙ্ক। কিন্তু আমার পাঠ্যপুস্তক খানার মাত্র “আট পৃষ্ঠা” পড়া এবং “মিশ্র যোগ” অঙ্ক কয়েকটি কষা হলে মক্তব বন্ধ করে দেওয়ান সাব দেশে গিয়ে আর ফিরে এলেন না। কিছুদিন পর খবর পাওয়া গেল যে, তিনি ইহধামে নেই। মক্তবটি উঠে গেল।
আমাদের পাড়ায় তখন ঘুড়ি উড়াবার প্রচলন ছিল খুব বেশী। মায়ের কাছে নগদ পয়সা চেয়ে পাবার আশা ছিল না। তাই ঘর হতে কিছু চাল চুরি করে বিক্রি দিয়ে, সেই পয়সা দ্বারা “চীন কাগজ” কিনে ঘুড়ি তৈরী করে তা পাড়ার ছেলেদের কাছে বিক্রি দিতে লাগলাম এবং এতে বেশ কিছু মুনাফা হতে লাগল। এর দ্বারা আমি কয়েকখানা “চিত্রাঙ্কন” শিক্ষার বই ও কাগজ কিনে নানাবিধ ছবি এঁকে একে দিন কাটাতে লাগলাম। আমার মা ছিলেন অত্যন্ত নামাজী মানুষ। তিনি আমার এ সব আনাড়ী কাজ আদৌ পছন্দ করতেন না, পাড়ার লোকেও না। সবাই মাকে বলত-ছবি দেখা, রাখা, আঁকা, এ সবই হারাম। এসব গোনাহর কাজে ছেলেকে আস্কারা দেবেন না, ছেলেটি আপনার “গোষ্ঠীছাড়া”। মা আপসোস করে বলতেন-“আল্লাহ্ ! তুমি সকলেরে দেলা পূত আর আমারে দেলা ভূত”।
১.০৪ পলায়ন (১৩২৪)
১৩২৩ সালে আমার ভগ্নিপতি আঃ হামিদ মোল্লা আমার সেজ ভগ্নীকে নেকাহ করে এসেছেন আমাদের সংসারে। তিনি এসে আমার নীলামী সম্পত্তিটুকু জমিদারের কাছ থেকে পুনঃ পত্তন গ্রহণ করলেন। কিন্তু জমির অর্ধেক কবুলিয়ত দিয়ে নিলেন তিনি তার মাতা মেহের জান বিবির বেনামীতে এবং অর্ধেক দিলেন আমাকে (নাবালক বিধায় আমি কবুলিয়ত দিতে না পারায়) আমার মাতার বেনামীতে। এ সময় তিনি আমাদের একান্ন ভূক্ত থেকে কৃষিকাজ করতেছিলেন। আমি তাঁর মাঠের কাজে সহায়তা না করে বেয়ারাপনা ও আনাড়ী কাজ করায় তিনি ছিলেন আমার উপর অত্যন্ত রুষ্ঠ ।
১৩২৪ সালের ৩রা চৈত্র। মোল্লা সাব দুপুরে হাল ছেড়ে মাঠ হতে এসে দেখতে পেলেন যে, আমি পুকুরের পাড়ে বসে “জলের কল” চালাচ্ছি। তখন ক্রোধান্ধ হয়ে তিনি আমাকে কয়েকটি কিল-চড় মেরে হাত ধরে একটি আছাড় দিলেন এবং বহু পরিশ্রমের তৈরী “জলের কল” ভেঙ্গে চুরে ফেলে ঘরে চলে গেলেন। আমি কিছু সময় কান্না করে ঘরে যেয়ে দেখি যে, মা ভাত পাক করছেন আর মোল্লা সাব-আমার বহু দিনের পুঁজী করা ছবি ও বই গুলি জ্বলন্ত চুলোয় দিয়ে জ্বলিয়ে দিচ্ছেন। উহা দেখে ক্ষোভে-দুঃখে আমি আবার কাঁদতে লাগলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম-আমি আর ছবিও আঁকব না, জলের কলও বানাব না, “হয়ত পড়ব, নয়ত মরব” ।
বেলা ১২টা। একখানা ছেড়া লুঙ্গি পরে ও একটি ময়লা জামার পকেটে চৌদ্দ আনা পয়সা গুজে অভুক্ত লুকিয়ে ঘর হতে বের হলাম পশ্চিম দিকে। বেলা দুটোয় বরিশাল পৌঁছে কিছু খেয়ে লক্ষ্যহীন ভাবে চলতে লাগলাম পশ্চিমে। কলেজ রোডে এক ভদ্রলোকের সহগামী হলাম। চলতে চলতে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-আমার বাড়ী কোথায়, কেন কোথায় যাব ইত্যাদি। আমি আমার ঠিকানা বল্লাম আর বল্লাম যে, কোথায় যাব, তা জানি না, তবে উদ্দেশ্য আমার লেখা-পড়া শিক্ষা করা। আমার বক্তব্য শুনে ভদ্রলোকটি আমাকে তার সঙ্গে যেতে বল্লেন। আমি রাজী হয়ে তার সাথে সাথে চল্লাম।