জ্ঞানদাস দার পরিগ্রহ করেন নাই। তাঁহার পিতা মাতার নাম জানিতে পারা যায় না। তাঁহার জন্ম এবং মৃত্যুর সন তারিখও পাওয়া যায় না। ১৬০০ শকে বাবা আউল মনোহর গুপ্ত হন। সুতরাং তাহার পূৰ্ব্বে জ্ঞানদাস। জীবিত ছিলেন স্থির করিয়া লইতে হইবে। গোবিন্দ দাস জ্ঞানদাসের পরবর্তী কবি।
মহাত্মা জ্ঞানদাস একজন সুবিখ্যাত পদ কৰ্ত্ত। বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাসের পদ অপেক্ষা ইহার রচিত পদগুলি নিকৃষ্ট নহে। ইনি বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাসের রচিত পদগুলির ভাব গ্রহণ করিয়া তাহার অনুকরণে অপূৰ্ব্ব পদ রচনা করিয়াছেন। জ্ঞানদাসের পদ গুলি যেমন সুন্দর তেমনি হৃদয়গ্ৰাহী। পদগুলি পড়িলেই বুঝিতে পারা যায় তিনি একজন পণ্ডিত ও সুরসিক ছিলেন। ইনি অনেক গুলি প্রশ্নদূতীকা পদ রচনা করিয়া গিয়াছেন। আজকাল এ ভাবের পদ রচনা বড়ই বিরল। জ্ঞানদাস যে একজন শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন তাহার কোনই সন্দেহ নাই।
জ্ঞানদাসের ষোড়শ গোপাল রূপ বর্ণনা অতি চমৎকার। বৈষ্ণব জগতে জ্ঞানদাসই প্ৰথম এই ষোড়শ গোপাল রূপ বৰ্ণনা করিয়াছেন। মুরলী শিক্ষার পদের তুলনা নাই। যত বার পাঠ করা যায় তত বার ঐ গুলি নুতন বলিয়া বোধ হয়। প্রবাস এবং মাথুর বর্ণনে জ্ঞানদাস বড়ই নৈপুন্য প্ৰকাশ করিয়াছেন। জ্ঞানদাস অনেক অনুরোগের পদ রচনা করিয়াছেন। বলিতে গেলে জ্ঞানদাস প্ৰায় সকল রসের পদই রচনা করিয়াছেন।
জ্ঞানদাসের রচিত পদ সম্বন্ধে সন ১৩০০ সালের ভাদ্র মাসের জন্মভূমিতে যাহা লিখিত হইয়াছে তাহার কতকাংশ নিম্নে উদ্ধৃত করিলাম–
“ভাষার মধুরতায়, রসের গাঢ়তায় ও ভাবের উচ্ছাসে বৈষ্ণব-কবিমণ্ডলীতে জ্ঞানদাসের আসন অতি উচ্চে। নাচিতে নাচিতে কথা গুলি বাহির হইয়া প্ৰাণ পুলকিত করিয়া তুলে। বৈষ্ণব কবিগণ অনেকেই সখীভাব সাধন করিয়াছিলেন। তাঁহারা আত্মহারা হইয়া সখীর মত, দশ দশায় শ্ৰীমতীর সেবা করিতেন, তাঁহাদের রচনায় সে জন্য একটা জীবন্ত ভাব দৃষ্ট হয়; সেরূপ আত্মহারা হইয়া এক একটী ভাবে না ডুবিলে কেহ সে ভাবের প্রাগাঢ়তা বুঝিতে পারে না, বুঝাইতেও পারে না। ভক্তি, বিনয় ও পাণ্ডিত্যে জ্ঞানদাস চৌষট্টী মোহান্তের একজন হইয়াছিলেন।”
শ্ৰীবিষ্ণুপ্রিয়া পত্রিকার চতুর্থ বর্ষের পঞ্চদশ সংখ্যায় যাহা প্ৰকাশিত হইয়াছে তাহার কতকাংশ এই–
জ্ঞানদাস পদ্য রচনায় যে রূপ রসিক নাগর ও গুণের সাগর ছিলেন তাহাতে তাঁহার পক্ষে মঙ্গল কি মনোহর উপাধি অতি সামান্য কথা। … জ্ঞানের কৃত পদ পদাবলীর অর্থ বড়ই গম্ভীর। ভাব অতি চমৎকার, ভক্তগণ বহু চিন্তা করিয়া লিখিয়া প্ৰকাশ করিতেন পদগুলি ঠিক প্ৰহেলিকার ধরণে। … ভাষা এমন সরল ও সুখ পাঠ্য যেন হীরার ধার। এখনকার কবিগণ আকাশ পাতাল ভাবিয়া সুকোমল ভাষায় পদ রচনা করিতে পারেন না।”
শ্রদ্ধাস্পদ শ্ৰীযুক্ত হারাধন দত্ত ভক্তিনিধি, মহাশয় পদসমুদ্র বাছিয়া অপ্ৰকাশিত পদ সকল আমাকে দয়া করিয়া দিয়াছেন। তাঁহারই কৃপায় আজি জ্ঞানদাস ঠাকুরের পদ সকল প্ৰকাশিত হইল। ভক্তিনিধি মহাশয়ের ঋণ এ জীবনে পরিশোধ করিতে পারিব না। শ্ৰীহট্ট মৈনা নিবাসী প্ৰাণতুল্য শ্ৰীযুক্ত অচ্যুত চরণ চৌধুরী মহাশয় কতকগুলি উপদেশ দিয়া পুস্তকের অভাব পূর্ণ করিয়াছেন। আমি তাহার নিকট তজ্জন্য চিরকৃতজ্ঞ। জেলারর বৰ্দ্ধমানের অন্তৰ্গত মুস্তুল নিবাসী প্ৰসিদ্ধ কীৰ্ত্তন গায়ক শ্ৰীহরি দাস মোহন্তের নিকট ৩টি এবং জেলা নদীয়ার অন্তঃপাতি কুমরি নিবাসী শ্ৰীযুক্ত পণ্ডিত সীতানাথ ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয়ের নিকট ৬টি অপ্রকাশিত পদ পাইয়াছি তজ্জন্য তাঁহাদের নিকটেও কৃতজ্ঞ রহিলাম।
নদীয়া বল্লভপুর নিবাসী শ্ৰীযুক্ত দীননাথ সরকার মহাশয় লীলা সমুদ্র নামক বহু প্ৰাচীন হস্ত লিখিত গ্ৰন্থ, মিরগি নিবাসী শ্ৰীযুক্ত কৃষ্ণ গোপাল অধিকারী পদার্ণব সারাবলী নামক সুপ্রাচীন হস্ত লিখিত গ্ৰন্থ, যমসেরপুর নিবাসী সুপ্ৰসিদ্ধ জমিদার শ্ৰীযুক্ত রাজেন্দ্র নারায়ণ বাগচি মহাশয় গীত কল্পতরু নামক হস্ত লিখিত গ্ৰন্থ আমাকে দয়া করিয়া দেওয়ায় যথেষ্ট উপকৃত হইয়াছি। তারও ৪/৫ জন মহাজন আমাকে হস্ত লিখিত গ্রন্থ সকল দিয়া ছিলেন। প্রকাশক শ্ৰীমান সুরেন্দ্রনাথ বসু ভায়া আমার অনেক বড় সাহায্য করিয়াছেন।
শ্ৰী রমণীমোহন মল্লিক
মেহেরপুর
জেলা নদীয়া। ৫ আশ্বিন ১৩০২