- বইয়ের নামঃ জ্ঞানদাস
- লেখকের নামঃ রমণীমোহন মল্লিক
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
০০. জ্ঞানদাসের জীবনী ও বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
জ্ঞানদাসের কবিতা এবং জীবনী আজ প্ৰকাশিত হইল। পদ কাল্পতরু, পদকল্প লতিকা, গীতচিন্তামণি, পদামুত সমুদ্র, গীতিরত্নাবলী, ক্ষণদা প্রভৃতি গ্রন্থে ২০৯টি পদ প্রকাশিত হইয়াছিল। পদসমুদ্র, লীলাসমূদ্র, পদার্ণব সারাবলী, গীতকল্পতরু এবং আরও ৩৪ খানি বহু প্ৰাচীন হস্ত লিখিত গ্ৰন্থ হইতে আরও ১০০টি অপ্ৰকাশিত পদ সংগ্ৰহ করিয়াছি। আমি যত্ন ও পরিশ্রম করিতে ক্ৰটি করি নাই, বৈষ্ণবজগতে ইহা আদরণীয় হইলে আমি চরিতার্থ হইব। আমার শারীরিক অসুস্থত হেতু এবং তীর্থের কাৰ্য্যে ব্যস্ততা প্রযুক্ত গ্রুফ দেখা ভাল হয় নাই সেই জন্য বিস্তর ভুল রহিয়া গিয়াছে। অনেক স্থলে ছাপার ভুলে অর্থ প্ৰমাদও ঘটিয়াছে। ভরসা করি পাঠক মহোদয়গণ আমাকে তজ্জন্য ক্ষমা করিবেন। নিবেদন ইতি।
শ্ৰী রমণীমোহন মল্লিক, মেহেরপুর, ৫ আশ্বিন ১৩০২
জ্ঞানদাসের জীবনী
প্ৰাচীন বৈষ্ণব কবিদিগের পদাবলী কতক কতক প্ৰকাশিত হইয়াছে বটে কিন্তু তাঁহাদিগের জীবনী আদৌ হয় নাই। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে প্ৰাচীন বৈষ্ণব কবিদিগের জীবনী সংগ্ৰহ করিবার নিমিত্ত বহুল ক্লেশ স্বীকার করা অনেক সময় বৃথা হইয় পড়ে। ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে ভক্তদিগের জীবনী যাহার পর নাই সংক্ষেপে বৰ্ণিত হইয়াছে।
বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত কোতুলপুর নামক যে একটী গণ্ডগ্ৰাম আছে সেখানে কয়েক ঘর গোস্বামী বাস করেন, তাঁহাত্মা মঙ্গল ঠাকুরের বংশ। গোস্বামী প্ৰভুদের মুখে জ্ঞানদাসের জীবনী কিয়ৎ পরিমাণে জানিতে পারা कित्रु দুঃখের বিষয় তাহাতে আকাঙ্ক্ষা না মিটিয়া হৃদয়ে ক্লেশ উপস্থিত হয়। ভক্তিরত্নাকর গ্ৰন্থ ভিন্ন; অন্য কোন প্ৰামাণিক গ্রন্থে জ্ঞানদাসের জীবনী পাওয়া যায় না। শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃতের আদি খণ্ডের একাদশ অধ্যায়ে জ্ঞানদাসের নাম ব্যক্ত রহিয়াছে দেখিতে পাওয়া যায়।
“পীতাম্বর আচাৰ্য্য, শ্ৰীদাস দামোদর।
শঙ্কর, মুকুন্দ, জ্ঞানদাস, মনোহর ॥”
জেলা বীরভূমের অন্তর্গত ইন্দ্ৰাণী নামে যে দেশ আছে, যে দেশে মহাভারত রচয়িত মহাত্মা কাশীরাম দাস বাস করিতেন, যে স্থানের ৪ ক্রোশ পূর্বে একচত্ৰু নগর যেখানে শ্ৰীশ্ৰীহারাই পণ্ডিতের আলয়ে শ্ৰীনিত্যানন্দ মহাপ্ৰভু জন্ম গ্ৰহণ করিয়াছিলেন সেই নগরের পশ্চিমে দুই ক্রোশ দূরে কাঁদড়া গ্রামে বিপ্ৰ কুলে মঙ্গল বংশে জ্ঞানদাস জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় :-
“রাঢ় দেশে কাদড়া গ্রামেতে নাম হয়।
তথায় বসতি জ্ঞানদাসের আলয়।।”
বৰ্দ্ধমান ও বীরভূমে অদ্যাপি “মঙ্গল ব্রাহ্মণ” নামে এক সম্প্রদায় ব্রাহ্মণ বাস করেন। জ্ঞানদাস মঙ্গল বংশে জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া তাহাকে কেহ মঙ্গল ঠাকুর কেহ শ্ৰীমঙ্গল এবং কেহবা মদন মঙ্গল বলিয়া সম্বোধন করিতেন। জ্ঞানদাস শ্ৰীনিত্যানন্দ মহাপ্রভুর শাখাভূক্ত।
জ্ঞানদাস শ্ৰীনিত্যানন্দ পত্নী শ্ৰীজাহ্নবা দেবীর নিকট মন্ত্র গ্ৰহণ করিয়া বৈরাগ্য ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করেন। তাঁহার জ্ঞাতি বৰ্গও শ্ৰীজাহ্নবা দেবীর নিকট মন্ত্র গ্ৰহণ করিয়া গোস্বামী পদে অভিহিত হইয়াছিলেন। কাঁদড়ায় জ্ঞানদাসের মঠ আদ্যাপি বিদ্যমান রহিয়াছে। প্রতি বৎসর পৌষ পূৰ্ণিমায় সেখানে জ্ঞানদাসের দিবসিক উপলক্ষ মহোৎসব হয় এবং তিন দিন মেলা হয়।
হুগলী জেলার অধীন বদনগঞ্জে বাবা আউল মনোহর দাস নামক এক জন পরম ভক্ত ছিলেন। তিনি প্ৰায় তিন শত বৎসর জীবিত ছিলেন। সারাবলী গ্রন্থে প্রমাণ পাওয়া যায় :–
“আদি নাম মনোহর, চৈতন্য নাম শেষ।
আউলিয়া হইয়া বুলে, স্বদেশ বিদেশ ৷”
মনোহর দাস একজন সুবিখ্যাত কবি ও পণ্ডিত ছিলেন। তিনি অনেক বৈষ্ণব গ্রন্থ সংগ্ৰহ করিয়াছিলেন। তাহার গ্রন্থ সকল বদনগঞ্জ নিবাসী মহাপ্ৰভু শ্ৰীনিত্যানন্দের পরিকর উদ্ধারণ দত্তের বংশাবতংস শ্ৰীযুক্ত হারাধন দত্ত ভক্তি নিধি মহাশয়ের পুস্তকাগারে শোভা পাইতেছে। নিৰ্য্যাসতত্ত্ব এবং পদ সমুদ্র বাবা মনোহর দাসের সংগৃহীত। পদসমুদ্র গ্ৰন্থখানি অদ্যাপি মুদ্রিত হয় নাই। ইহাতে ১৫০০০ পদ আছে।
বাবা আউল কোন কুলে কোন স্থানে জন্ম গ্ৰহণ করিয়াছিলেন তাহা জানিতে পারা যায় না। তিনি সখীভাবে শ্ৰী রাধাকৃষ্ণের ভজন সাধন করিতেন। তিনি ঘাঘরা পরিতেন, কাঁচলি বক্ষে আঁটিতেন, সীঁথায় সিন্দুর পরিতেন। নিজে পদ রচনা করিয়া আক্ষেপ করিয়া মুরলীকে সম্বোধন করিয়া বলিতেন :
“শ্যামের মুরলী, হৃদয় খুবলী, করিলি সকল নাশ।
… … … …
যাহার যে রীতি, না ছাড়ে কখন, কহে মনোহর দাস।।”
–পদ সমুদ্র ১৪০৪৩
অদ্যপি বদনগঞ্জে বাবা আউলের সমাধি আছে।
মনোহর দাস জ্ঞানদাসের বন্ধু ছিলেন। উভয়ে সৰ্ব্বদা একত্রে থাকিতেন। উভয়েই শ্ৰীজাহ্নবার শিষ্য ছিলেন। কোন স্থানে আহবান হইলে উভয়েই একত্রে গমন করিতেন। খেতুরীর মহোৎসবে উভয়েই একত্রে গমন করিয়াছিলেন।
“শ্রীল রঘুপতি, উপাধ্যায় মহিধর।
মুরারী, মুকুন্দ, জ্ঞানদাস, মনোহর।।”
–“নরোত্তম বিলাস।”
খেতুরী হইতে শ্ৰীজাহ্নবা দেবীর সহিত জ্ঞানদাস শ্ৰীবৃন্দাবনে গমন করিয়া ছিলেন এবং শ্ৰীজীব গোস্বামী তথায় ইঁহাদিগকে অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন।