কার্টুনিস্ট শংকর, কুট্টি, আর. কে. লক্ষ্মণ বা আমাদের চণ্ডী লাহিড়ী কংগ্রেস নেতাদের যে ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন, তা পুরোপুরি ঠিক না হলেও অনেকাংশে ঠিক। কংগ্রেসী নেতাদের মোটামুটি ঐ রূপ। মুখে কোন দুশ্চিন্তার ছাপ নেই, চেহারা দেখে মনে হয় না তিন পুরুষের মধ্যে কেউ কোন দিন কায়িক পরিশ্রম করেছেন। এরা চাকরি করেন না, ব্যবসা করেন না, কিন্তু তবু এদের সংসারে প্রাচুর্যের বন্যা। রেলগাড়ি চড়লে এদের কৌলীন্য যায়। মোটরগাড়ি ছেড়ে এক কিলোমিটার রাস্তা হাঁটলেই তা পদযাত্রার গৌরব লাভ করে খবরের কাগজে ছবি ছাপা হয়। আরো কত কি। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে এবং নিঃসন্দেহে লালবাহাদুর শাস্ত্রী তার সব চাইতে বড় নিদর্শন।
রাজনৈতিক দিক থেকে শাস্ত্রীজি নেহরুর একান্ত অনুরক্ত ছিলেন, এ কথা সর্বজনবিদিত, কিন্তু এ কথা বোধ হয় অনেকেই জানেন না, ইনি নেহরুজীর তিনমূর্তি ভবনের বিলাসবহুল বিধিব্যবস্থা মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনমূর্তি ভবনের সংসার চালাত সরকারী অতিথি সেবা বিভাগ ( গভর্ণমেন্ট হসপিটালিটি অরগানাইজেসান) এবং যত দূর মনে পড়ছে নেহরু তার ব্যক্তিগত খরচের জন্য দৈনিক মাত্র সাড়ে সাত টাকা সরকারী অতিথি সেবা বিভাগকে দিতেন। গৌরী সেনের টাকায় সংসার চলত বলে তিনমূর্তি ভবনে প্রাচুর্যের বন্যা বইত। বেয়ারা, চাপরাশী, কেরানী, স্টেনোগ্রাফার, নিরাপত্তা : কর্মী, প্রাইভেট সেক্রেটারি, অতিথি-অভ্যাগতদের আদর-আপ্যায়নের জন্য ঢালাও ব্যবস্থা ছিল। এর জন্য কত টাকা ব্যয় হত তা জানার উপায় নেই, কারণ সরকারী অতিথি সেবা বিভাগ রাষ্ট্রপতি ভবনের অধীনে ছিল এবং রাষ্ট্রপতির বাজেটের মধ্যেই এ সব খরচ ধরা হত। শুধু খাওয়া-দাওয়া নয়, মোটরগাড়িরও ঢালাও ব্যবস্থা ছিল; কারণ পণ্ডিতজীর নিজস্ব গাড়ি ছাড়া অন্য সব গাড়ি আসত রাষ্ট্রপতি ভবনের গ্যারেজ থেকে।
লালবাহাদুর কোন দিন মুখে কিছু বলেননি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি বুঝিয়ে দিলেন, না, গৌরী সেনের টাকায় সংসার চালাতে তিনি আগ্রহী নন। অতিথি সেবা বিভাগকে বলা হল, যাও, রাষ্ট্রপতি ভবনে ফিরে যাও। রাষ্ট্রপতি ভবনের গাড়িও চাই না, ও সব ব্যবহার হবে রাষ্ট্রপতি ও সরকারী অতিথিদের জন্য। বিশিষ্ট অতিথি আপ্যায়ন? নিশ্চয়ই হবে, কিন্তু বাড়িতে কেন? তার জন্য তো রাষ্ট্রপতি ভবন, হায়দ্রাবাদ হাউস ও সরকারী ভাল ভাল হোটেল আছে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যারা আসবেন, তাঁদের জন্য? টি বোর্ডকে বলে দাও, ওরা চা খাওয়াবে। বাড়ি-ঘরদোর সাজানো গোছানা? না, লাখ লাখ টাকার ফার্ণিচার আর কার্পেট দিয়ে বাড়ি সাজাতে হবে না। যা আছে, তাতেই চলবে। অফিসে? হ্যাঁ, ওখানে দুটো-একটা ঘর সুসজ্জিত থাকুক, কিন্তু আহা মরি করার কোন প্রয়োজন নেই। ঘরে ঘরে এয়ার কণ্ডিশনার? নো, নেভার। দরজায় মোটা সিল্কের পর্দা? লাখ টাকা খরচ করে পর্দা তৈরি করতে হবে না। অল্প খরচেও ভাল পর্দা হয়।
দেশী-বিদেশী রাজা-মহারাজা আর বিলেত ফেরত সাহেবসুবাদের ভজনা করতে করতে আমরা সৎ, ভদ্র ও আদর্শবাদী ভারতীয়দের শ্রদ্ধা করতে ভুলে গেছি। তাই তো এক দল লোক শাস্ত্রীজিকে নিয়ে জঘন্য বিদ্রূপ করতেও দ্বিধা করেননি এবং এরা প্রচার করেন যে শাস্ত্রীজি কায়রোয় গিয়ে হোটলে নিজের শোবার ঘরে রান্নাবান্না করার জন্য লাখ টাকা খেসারত দিতে হয়। নেহরুর একটা মন্তব্যের জন্য অতীতের ভারত-ভক্ত নেপাল ভারত বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। শাখা সিঁদুর আর মাথায় ঘোমটা পরা স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে সহজ সরল অমায়িক ব্যবহার করেই শাস্ত্রীজি নেপালের পররাষ্ট্র নীতিতে মোড় ঘুরিয়ে দেন। এই ছোট্টখাট্ট মানুষটিই আমেরিকা যাত্রার কদিন আগে প্রেসিডেন্ট জনসনের একটা মন্তব্যের প্রতিবাদে আমেরিকা সফর বাতিল করেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষর না করেই পাকিস্তানকে উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করার অনুমতি দেন।
আজকের আসাম আন্দোলনের পটভুমিকায় একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সে সময় মাঝে মাঝেই অভিযোগ শোনা যেত, আসামের কয়েকজন বিশিষ্ট ক্ষমতাশালী কংগ্রেস নেতার পৃষ্টপোষকতায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেশ কিছু লোকজন বে-আইনী ভাবে আসামে অনুপ্রবেশ করছে। এ নিয়ে পার্লামেন্টে ও আসাম-পশ্চিম বাংলার বিধানসভায় তর্ক-বিতর্কও হত। কাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই অনুপ্রবেশ হত, তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও সবাই জানতেন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী আসামের কিছু চা বাগানের মধ্যে দিয়ে রাত্রির অন্ধকারে বেশ কিছু মানুষ বে-আইনী ভাবে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে আসামে চলে আসতেন।
একদিন পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলে আসামের কয়েকজন এম. পির কাছে শুনলাম, সীমান্তবর্তী একটা বিরাট চা বাগান সাহেবরা এক মাড়োয়ারী কোম্পানির কাছে বিক্রী করছে এবং পরদিনই গৌহাটিতে এই লেনদেন চূড়ান্ত হবে। ওরা আশঙ্কা করছিলেন, ঐ চা বাগানটি মাড়োয়ারীদের হাতে গেলে এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদদের চাপে এই বাগান দিয়ে বে-আইনী অনুপ্রবেশ আরো বেড়ে যাবে। তদানীন্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাস্ত্রীজির কাছে খবরটা পৌঁছে গেল অপরাহ্নের দিকে। বিকেলের দিকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তরের সর্বাধিনায়ক ভোলানাথ মল্লিকের তলব পড়ল।