.
উপরাষ্ট্রপতি ডক্টর জাকির হোসেন অসুস্থ হয়ে অল ইণ্ডিয়া মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রীজি তাঁকে দেখতে গেলেন। সঙ্গে আমিও আছি। হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে সফদারজং রেলওয়ে লেভেল ক্রশিং বন্ধ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি থমকে দাঁড়াল। একটু দূরে একটা লোক আখের রস বিক্রী করছিল। ওকে দেখতে পেয়েই শাস্ত্রীজি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, পয়সা আছে?
প্রশ্ন শুনে একটু বিস্মিত হলেও বললাম, আছে।
এবার একটু হেসে বললেন, হাজার হোক উত্তর প্রদেশের মানুষ। আখের রস খেতে ইচ্ছা করছে। খাওয়াবে?
কিন্তু আপনি কী এই আখের রস খাবেন?
চিরকালই তো এই রকম রাস্তার ধারের দোকান থেকে আখের রস খেয়েছি। এখন খাব না কেন?
রাস্তার ধারের একজন অতি সাধারণ দেহাতী লোকের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রী আখের রস খাবেন শুনেই সঙ্গী নিরাপত্তা কর্মীরা চমকে উঠলেন। প্রধানমন্ত্রী হেসে বললেন, ভয় নেই। এর হাতের আখের রস খেয়ে আমি মরব না।
আজ এক নম্বর ইয়র্ক প্লেসের কথা বলতে গিয়ে আরো কত কথা মনে পড়ছে। শাস্ত্রীজির বড় ছেলে হরি এক বিখ্যাত বিদেশী প্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর শিক্ষানবীশ থাকার পর ওদেরই ভারতীয় সংস্থায় চাকরি পেল। বাড়ি, গাড়ি ও হাজার টাকার ওপর মাইনে। হরি ভেবেছিল, বাবা খুব খুশি হবেন কিন্তু নিয়োগপত্র দেখে উনি কিছুই বললেন না। পরের দিনই শাস্ত্রীজি ঐ সংস্থার সর্বময় কর্তাকে লিখলেন, ছেলেকে চাকরি দিয়েছেন জেনে খুশি হলাম কিন্তু বাড়ি-গাড়ি ছাড়াও অত টাকা মাইনে পাবার মত যোগ্যতা তো আমার ছেলের নেই। সুতরাং অন্য পাঁচজনের মত যদি ওকে সাধারণ মাইনে দেন, তাহলে সে চাকরি করবে, অন্যথায় নয়।
এ ধরনের চিঠি কী আর কারুর কাছে আশা করা যায়?
যাই হোক, এই চাকরির সূত্রে হরিকে প্রায়ই ভূপাল যেতে হত। শাস্ত্রীজি খবর পেলেন, রেল স্টেশনে ওঁর ছেলেকে অভ্যর্থনা করার জন্য কখনও মুখ্যমন্ত্রী, কখনও বা অন্য মন্ত্রীরা উপস্থিত থাকেন। এই খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই শাস্ত্রীজি মুখ্যমন্ত্রী শঙ্করদয়াল শর্মাকে ফোন করে বললেন, আমি প্রধানমন্ত্রী, আমার ছেলে প্রধানমন্ত্রী না। সুতরাং আমার ছেলেকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য কোন মন্ত্রীই যেন স্টেশনে না যান।
একবার শাস্ত্রীজি তাঁর এক অতি বিশ্বস্ত ও স্নেহভাজন ব্যক্তিগত কর্মচারীকে হঠাৎ নিজের দপ্তর থেকে সরিয়ে দেন। কেন? উনি জনৈক ব্যবসায়ীকে একটু সাহায্য করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক জয়েন্ট সেক্রেটরিকে টেলিফোন করেছিলেন। এই ভদ্রলোককে আর কোন দিন শাস্ত্রীজি বাড়িতে ঢুকতে দেননি।
আরো মজার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে।
প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী একদিনের কলকাতা সফরে যাচ্ছেন। প্রথম বার কলকাতা দেখার জন্য ওঁর পরিবারের কয়েকজন সঙ্গে আছেন। এ ছাড়া তদানীন্তন শিল্পমন্ত্রী ও বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল শ্ৰী টি. এন. সিং, রেলমন্ত্রী শ্রী দাসাঞ্জা, আইনমন্ত্রী শ্রী অশোক সেন ছাড়াও জেসপ কোম্পানির চেয়ারম্যান শ্ৰী অশোক চন্দ ও আমিও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কলকাতা যাচ্ছি। কলকাতায় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম কাৰ্যসূচী জেসপ কোম্পানির ১৫০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উৎসবে যোগদান। উৎসবটি এমন সময় হচ্ছিল যখন ভারতবর্ষের এক বিখ্যাত শিল্পপতি আস্তে আস্তে জেসপ কোম্পানির শেয়ার কিনে নিজের কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছিলেন। অন্য দিকে সরকার ভাবছিলেন, যে কোম্পানিকে বহু সরকারী সাহায্য দেওয়া হয়েছে এবং যার প্রায় সমগ্র উৎপাদনই সরকার কিনে নেন, সে কোম্পানির মালিকানা পরিচালনা সরকারের হাতে আসাই ঠিক হবে কিনা। কংগ্রেস সিণ্ডিকেটের কিছু নেতা ঐ শিল্পপতিকে বুঝিয়েছিলেন, আমরাই শাস্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী করেছি। সুতরাং আমরা বললে উনি নিশ্চয়ই জেসপ কোম্পানির সরকারী পরিচালনায় আনতে পারবেন না। পশ্চিমবঙ্গের এক বিখ্যাত কংগ্রেস নেতাও ঐ শিল্পপতিকে খুব সাহায্য করছিলেন।
দিল্লীর পালাম বিমানবন্দর থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিমান টেক-অফ করার পাঁচ-দশ মিনিট পরেই শাস্ত্রীজি শ্ৰীচন্দকে নিজের কেবিনে ডেকে পাঠালেন। দশ-পনেরো মিনিট পর শ্রীচন্দ আমাদের কেবিনে ফিরে আসতেই প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি, ওঁর হাতে জেসপ কোম্পানির ১৫০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিক অনুষ্ঠানের নানা কাগজপত্র। মঞ্চে কে কোথায় বসবেন তার প্ল্যান আমাকে দেখিয়ে বললেন, আই ডোন্ট ওয়ান্ট দিস জেন্টলম্যান (ঐ শিল্পপতি) টু বী সীটেড অন দ্য ডায়াস। ক্যান ইউ হেলপ মী?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই পারব।
তাহলে যা হয় একটা ব্যবস্থা কর।
আমি প্রধানমন্ত্রীর সামনে বসেই একটা সাদা কাগজ লিখলাম আর্জেন্ট মেসেজ ফর মিস্টার পি. কে. বাসু ডি আই জি / আই বি মিস্টার…সুড নট বি সিটেড অন দ্য ডায়াস। প্লিজ কনফার্ম। কাইণ্ডলি রিপ্লাই উইদিন্ ফিফটিন মিনিটস। ককপিটে গিয়ে মেসেজটি কমাণ্ডার অব দ্য এয়ারক্রাফটকে দিয়ে বললাম, এক্ষুণি এই মেসেজটি দমদম কন্টোলে পাঠান এবং উত্তর এলেই আমাকে জানাবেন।
পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই প্রসাদবাবু আমাকে জবাব দিলেন ব্যবস্থা করছি।
তারপর? না, ঐ শিল্পপতি অনেক তর্ক বিতর্ক করেও মঞ্চে বসার সুযোগ পাননি। সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা তাকে দর্শকদের একটি আসনেই বসিয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই শিল্পপতির হাতে জেসপ কোম্পানিকে তুলে দেননি শাস্ত্রীজি। মজার কথা, এই মানুষটি সম্পর্কে একদল রাজনীতিবিদ প্রচার করতেন, আমাদের পরামর্শ ছাড়া ওঁর পক্ষে কোন কিছু করা অসম্ভব নয়।