পন্থজীর পার্সোন্যাল সেক্রেটারি জানকীবাবুকে টেলিফোন করেই ছনম্বর মৌলানা আজাদ রোডে হাজির হলাম। পন্থজীর হাতে রিপোর্টটা দিলাম। উনি পড়েই বললেন, এ খবর তুমি কোথায় পেলে?
আমি বললাম, রায়পুর কংগ্রেস অধিবেশন থেকে ফেরার পথে কিভাবে খবরটা পেয়েছি।
পস্থজী হেসে বললেন, খবরটা ঠিকই পেয়েছ কিন্তু এ সময় এ খবর না বেরোনই ভাল।
এ প্রায় কুড়ি বছর আগেকার কথা কিন্তু আজই প্রথম এ খবরের কথা লিখলাম।
০২. বিজ্ঞান ভবন থেকে বেরিয়ে
বিজ্ঞান ভবন থেকে বেরিয়ে জনপথ ধরে দক্ষিণের দিকে একটু এগুলেই এক নম্বর ইয়র্ক প্লেস। নতুন নাম মতিলাল নেহরু প্লেস। ওদিকে গেলেই আধুনিক ভারতবর্ষের ফতেপুর সিক্রীর সামনে না দাঁড়িয়ে পারি না।
কোথাও কোন প্রাণচাঞ্চল্য নেই, নেই বিশেষ কোন মানুষের আনাগোনা। ইয়র্ক প্লেসকে ঘুরে জনপথের উপর দিয়ে দিনরাত কত গাড়ি-ঘোড়া মানুষজনের ছোটাছুটি, কিন্তু না, তারাও কেউ মুহূর্তের জন্য এই ফতেপুর সিক্রীর সামনে দাঁড়ান না। সবাই ব্যস্ত? কারুরই সময় নেই? নাকি প্রয়োজন নেই?
একদিন এই এক নম্বর ইয়র্ক প্লেসই ফতেপুর সিক্রীর মত ভারত ভাগ্য-বিধাতার আস্তানা ছিল। তখন কত সান্ত্রী চারপাশে ঘোরাঘুরি করত, ত্বরিত পদক্ষেপে আসা-যাওয়া করতেন আসমুদ্রহিমাচলের রথী মহারথীরা। সরকারী আমলাদের কাছে তখন এ বাড়ি মক্কা-মদিনা, ক্ষমতালোভী স্বার্থপর রাজনীতিবিদদের কাছে এই ফতেপুর সিক্রীই ছিল কৈলাস-মানস সরোবর।
আজ? ফতেপুর সিক্রীর মত এক নম্বর ইয়র্ক প্লেসও অতীত ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায়। আর লালবাহাদুর শাস্ত্রী? কাব্যে উপেক্ষিতা ঊর্মিলার মত আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসের সর্বজন উপেক্ষিত মহানায়ক।
অতীতের এক নম্বর ইয়র্ক প্লেস ও আজকের এক নম্বর মতিলাল নেহরু প্লেসে পা দিতেই কত কথা মনে পড়ছে। প্রথম দিনের আলাপেই চমকে গিয়েছিলাম।
.
দু-এক মাস আগেই দিল্লী এসেছি। দু-চারদিন পর পরই নেহরু সন্দর্শনে তিনমুর্তি ভবনে যাই। মাঝে মাঝে শাস্ত্রীজিকে দেখি কিন্তু কথা হয় না। তারপর হঠাৎ একদিন আমাকে দেখিয়ে উনি নেহরুকে বললেন, পণ্ডিতজী, এই ছেলেটার বিরুদ্ধে আমার একটা নালিশ আছে।
আমি চমকে উঠলাম।
শাস্ত্রীজি হাসতে হাসতে বললেন, হি কামস টু ইউ এভরি নাউ এ্যাণ্ড দেন কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা করে না।
পণ্ডিতজী সঙ্গে সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নটি বয়! তুমি রোজ লালবাহাদুরের সঙ্গে দেখা করবে।
সত্যি এরপর থেকে বোজ শাস্ত্রীজির বাড়ি যেতাম। দিল্লীতে আছি অথচ ওঁর সঙ্গে দেখা হয়নি, এমন দিনের কথা মনে পড়ে না। না গিয়ে পারতাম না। সহজ, সরল, অনাড়ম্বর এই মানুষটি আমাকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করতেন।
একবার আমি পণ্ডিতজীর তিনমূর্তির বাড়িতে কলকাতার এক যশস্বী রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীর সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করলাম। পণ্ডিতজীর ব্যক্তিগত ড্রইংরুমে অনুষ্ঠিত এই ঘরোয়া আসরে আমন্ত্রিত ছিলেন গোবিন্দবল্লভ পন্থ, শাস্ত্রীজি, শ্ৰীমতী উমা নেহরু, লেডী রামা রাও, এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জী, শ্রীমতী সারদা মুখার্জী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তায়েবজী ও আরো কজন ছাড়া নেহরু পরিবারের কয়েকজন। আমি পণ্ডিতজী আর শাস্ত্রীজিকে গানের মোটামুটি অর্থ ইংরেজিতে বলে দিচ্ছিলাম। অনুষ্ঠানের শেষে শাস্ত্রীজি আমাকে বললেন, আমি রবিবাবুর সব বই পড়েছি। গীতাঞ্জলি, চোখের বালি, গোরা আর রাশিয়ার চিঠি যে কতবার পড়েছি তার ঠিক ঠিকানা নেই, কিন্তু লজ্জার কথা, রবিবাবুর গান বিশেষ শুনিনি। তাই বলছিলাম, যদি একদিন আমার বাড়িতে গানের আয়োজন কর তাহলে খুব খুশি হতাম।
পরের দিনই শিল্পীর কলকাতায় ফেরার কথা। রেলের টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছিল। শাস্ত্রীজি ওকে বললেন, আমি আবার রিজার্ভেশন করে দেব। কলকাতায় খবরও দিয়ে দিচ্ছি। আপনি একদিন থেকে গেলে বাড়ির সবাইকে রবিবাবুর গান শোনাতে পারি।
এমন আন্তরিক খোলাখুলি কথা শুধু উনিই বলতে পারতেন।
.
পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থ মারা যাবার পর শাস্ত্রীজি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। তখনকার দিনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বের সীমা ছিল না। আইন-শৃঙ্খলা, আই-সি-এস আই-এ-এস / আই-পি-এস প্রভৃতি সমস্ত সর্ব ভারতীয় সার্ভিসেস, সমগ্র গোয়ন্দা বিভাগ, বিশেষ পুলিশ সংস্থা, বিভিন্ন রাজ্য সরকারের মধ্যে সমন্বয়, হাইকোর্ট-সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ ও তাদের চাকরি-বাকরি সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়, সিবিআই, ভূতপূর্ব দেশীয় রাজ্যের রাজাদের রাজন্য ভাতা ও তাদের উত্তরাধিকারী, কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল, রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেওয়া, কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত কর্মচারীদের চাকরি-বাকরি সংক্রান্ত বিষয়, ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা এবং আরো অনেক কিছু বিষয় ও বিভাগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীনে ছিল। এই গুরুদায়িত্ব বহন করতে শাস্ত্রীজিকে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হত। সকালে সাড়ে আটটা-নটার আগে কাজ শুরু না করলেও প্রতি দিন রাত্রে দুটো-আড়াইটে পর্যন্ত কাজ করতেন।
শাস্ত্রীজি সাধারণত রাত নটা সাড়ে নটা পর্যন্ত অফিসে কাজ করতেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ ওঁকে বাড়ি ফিরে যেতে দেখেই একটু খটকা লাগল। মনে হল, বোধ হয় পারিবারিক কোন অনুষ্ঠান আছে; কিন্তু না, পারিবারিক কারণে উনি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরেননি। পারিবারিক ভৃত্য-পুত্রের নিউমোনিয়া হয়েছে শুনেই উনি বাড়ি ফিরেছেন। সেদিন আর কোন কাজ নয়। ভৃত্য-পুত্রের চিকিৎসার বিধিব্যবস্থা ও সেবাযত্নের তদারকী করেই সারা রাত কাটিয়ে দিলেন।