আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর উঠে দাঁড়ালাম। তবু কথা হয়। তারপর উনি ডক্টর মল্লিককে বলেন, মল্লিক সাহেব, নিমাইবাবুকে তাড়াতাড়ি ঢাকা পাঠান।
ওঁকে বার বার ধন্যবাদ জানিয়ে বিমুগ্ধ মনে রাষ্ট্রপতি ভবনের দ্বারকা সুইটের ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
পূজা সংখ্যার লেখা নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলাম বলে তখনই ঢাকা যেতে পারলাম না। গেলাম কয়েক মাস পরে ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারির উৎসবে যোগ দিতে।
ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেসান্স-এর অন্যতম জয়েন্ট সেক্রেটারি ও আমার বিশেষ বন্ধু শ্রীনিবাসন হঠাৎ একদিন ফোন করে বলল, নিমাই, ইণ্ডিয়ান রাইটার্স ডেলিগেশনের মেম্বার হয়ে তোমাকে ঢাকা যেতে হবে।
আমি হেসে প্রশ্ন করি, হঠাৎ আমাকে যেতে হবে কেন?
শ্ৰীনিবাসনও হেসে জবাব দেয়, আমি তো ভাবতেই পারি না তুমি সাহিত্যিক হয়েছ এবং আমার একটুও ইচ্ছা ছিল না, তোমাকে পাঠানো হোক। কিন্তু কী করব? ঢাকা থেকে বার বার টেলেক্স আসছে।
শ্রদ্ধেয় অন্নদাশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে ভারতীয় সাহিত্যিক প্রতিনিধি দলের সব সদস্য পৌঁছবার তিন দিন পরে আমি ঢাকা পৌঁছলাম বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক রাত্রে শহীদ স্তন্তে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে মাল্য অর্পণ করতে গেলাম আমি আর সুশীলদা (রায়)। ঐ অনুষ্ঠানে শহীদ স্তম্ভে প্রথম মাল্য অর্পণ করলেন মুজিব, তারপর বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালিকা নীলিমাদি (ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম) এবং তারপরই আমরা। সেখানে মুজিবকে দেখে চমকে উঠলাম! গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রনায়কের জন্য এত স্টেনগানধারী দেহরক্ষী! বুঝলাম দেশের মানুষকেই দেশনায়ক বোধহয় বিশ্বাস করেন না। মনে মনে হাসি আর ভাবি, এইসব দেশনায়করা কী মনে করেন কজন সঙ্গীনধারীই তাদের একমাত্র ও নির্ভরযোগ্য ভরসা? পৃথিবীর কোন দেশের কোন রাষ্ট্রনায়ক শুধু সঙ্গীনধারীদের উপর নির্ভর করে চিরকাল গদী আঁকড়ে থাকতে পেরেছেন? কেউ না। ওঁরা কী ইতিহাসের এই সরল সত্যটিকেও ভুলে যান?
আমি সেই ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারির মাঝরাতেই ঈশান কোণে প্রথম ঘন কালো মেঘের ইঙ্গিত পাই।