আমি হাসি।
উনি হেসে বলেন, ডু ইউ নো, উই হ্যাভ বিকাম ফ্রেণ্ডস।
পাকিস্তান রাষ্ট্রপতির এই বন্ধুত্বের দাম কি হতে পারে, তা জানি বলেই আমিও হেসে জবাব দিই, আই অ্যাম সো হাপি টু নো ইট, ইওর একসেলেনসী!
এই ক্লারিজস হোটেলে পাকিস্তান হাই কমিশনের এক দল বাঙ্গালী কুটনীতিবিদ আয়ুব খানের জন্য ডিউটিতে ছিলেন এবং তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতা হয়। ওঁরা মাঝে মাঝে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাঙ্গালী খানা খাইয়ে দিতেন এবং এদেরই কয়েক জনের উদ্যোগে ও সাহায্যে আমি দিল্লী ফেরার পথে করাচী ঘুরে আসি। মজার কথা, পাকিস্তানের ঐ বাঙ্গালী কূটনীতিবিদদের সঙ্গে হৃদ্যতার ফলেই জন্ম নেয় আমার উপন্যাস ডিপ্লোম্যাট। যাইহক লণ্ডন থেকে দিল্লী ফেরার পথে দুদিন করাচীতে কাটিয়েই বুঝেছিলাম, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আয়ুব খান পাকিস্তানের জনগণকে মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত করা শুরু করেছেন পুরোদমে। প্রতিটি সংবাদপত্র ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। অনুমান করতে কষ্ট হলো না নেপথ্যে সামরিক প্রস্তুতি আরো কতদূর এগিয়েছে।
পাকিস্তানের এই সব যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়কদের অদূরদর্শিতার জন্যই জন্ম নেয় বাংলাদেশ। রঙের উপর বসান চড়িয়েছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর ইতিহাসে সে এক অনন্ত অধ্যায়।
.
বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে দিল্লীতে থাকি। বিকেলবেলায় কলকাতার বাংলা খবরের কাগজগুলো পড়তে পড়তে চোখের জল ফেলি মুজিব ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। ঘটনা ঘটে চলে বিদ্যুত গতিতে! ভারত-সোভিয়েট ইউনিয়নের মৈত্রী চুক্তি, নিক্সনের হুমকি, আণবিক অস্ত্রসজ্জিত মার্কিন সপ্তম নৌবহরের সন্দেহজনক গতিবিধি, জেনারেল ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর ছল-চাতুরি, ঢাকায় বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী নিধন। আরো কত কি। শেষ পর্যন্ত একদিন লেঃ জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলেন লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। তারপরও আরো কত কি! একদিন আবার মুজিব ফিরে এলেন ঢাকায় নবজাত রাষ্ট্রের কর্ণধাররূপে।….
দিল্লীতে বাংলাদেশের প্রথম হাই কমিশনার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী (বর্তমানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব)। নিছক খবর বা সৌজন্যের জন্য ওঁর গ্রেটার কৈলাসের দপ্তরে যাই। পরবর্তী হাই কমিশনার হলেন ডক্টর এ, আর মল্লিক। ইতিহাসের যশস্বী অধ্যাপক ও কূটনীতিবিদ ডঃ মল্লিকের সঙ্গে খুবই হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠল। আমার বই বেরুতে না বেরুতেই উনি আর ভাবীজি পড়ে ফেলেন। ঢাকা থেকে আগত অতিথিদের পড়ান। একদিন উনিই আমার মেমসাহেব ও ডিপ্লোম্যাট পাঠিয়ে দিলেন শেখ সাহেবের কাছে।
১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি মুজিব দিল্লী এলেন শ্ৰীমতী গান্ধীর আমন্ত্রণে। এয়ারপোর্টে উপস্থিত ছিলাম। সন্ধ্যায় রিপোর্ট পাঠালাম।
পরের দিন সকালে এক বন্ধুর পরিবারের কয়েকজনের জন্য ভিসা নেবার ব্যাপারে ইরাক দূতাবাসে গেছি। হঠাৎ ঐ দূতাবাসেই আমার টেলিফোন এলো বাড়ি থেকে-রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ফোন এসেছে এখুনি মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য। ঠিক বিশ্বাস করতে পারলাম না। বাড়ি এসেই রাষ্ট্রপতি ভবনে ফোন করলাম শেখ সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারিকে। হ্যাঁ, সত্যি আমাকে এখুনি মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। যে মানুষটির জন্য দিনের পর দিন চোখের জল ফেলেছি, যিনি লক্ষ-কোটি বাঙ্গালীর হৃদয়-সম্রাট, সেই মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে রওনা হলাম খানকয়েক বই হাতে নিয়ে। দীপ্তিও সঙ্গে চলল। বুঝলাম, মল্লিক সাহেব ও মেমসাহেব–ডিপ্লোম্যাটের জন্যই এই অভাবনীয় সৌভাগ্য সম্ভব হলো।
শেখ সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারি বললেন, আপনার সময় পনের মিনিট বারোটা পঁয়তাল্লিশ থেকে একটা। ওঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইতিহাসের প্রবাদপুরুষের ঘরে ঢুকলাম। মল্লিক সাহেব আমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বই দিলাম। মহা খুশি। তারপর পাশে বসিয়ে বললেন, নিমাইবাবু, আপনি ডিপ্লোম্যাট লিখে সাহিত্যিক হিসেবে একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি আপনার মেমসাহেব আর ডিপ্লোম্যাট পড়ে সত্যি মুগ্ধ।
আমি সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানালাম।
উনি বললেন, যে বইগুলো দিলেন, তাও পড়ব তবে সময় লাগবে। এত কাজের চাপ যে পড়াশুনা করার সময় পাওয়াই মুস্কিল।
দীপ্তি মুগ্ধ হয়ে ওঁকে দেখে। আমিও বিশেষ কথা বলি না। উনি বলে যান, আমরা পলিটিসিয়ান। নানা কারণে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী অনেক সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য কিন্তু আপনারা সাহিত্যিকরা, শিল্পীরা মুক্ত মনের মানুষ হন বলেই ইতিহাসের পাতা থেকে পলিটি সিয়ানদের নাম মুছে গেলেও আপনাদের কেউ ভোল না।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত ওঁর কথা শুনি।
এই যে বাংলাদেশ হলো, তা কী আমি না আওয়ামী লীগ জন্ম দিয়েছে? এর আসল জন্মদাতা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংবাদিক আর একদল পাগল ছাত্র। ওরা সাহায্য না করলে কী আমরা কজন পলিটিসিয়ান দেশের মানুষকে এমনভাবে মরতে অনুপ্রাণিত করতে পারতাম?
উনি একটু থেমে বললেন, রবীন্দ্রনাথ কবে লিখেছিলেন, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি আর কবে আমরা তার মর্ম উপলব্ধি করলাম?
আরো কত কথা বলার পর উনি আলতো করে আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, নিমাইবাবু, ভাল করে লিখুন, সত্যি কথা লিখুন। আমরা পলিটিসিয়ানরা রাজনৈতিক কারণে চরিত্রহীন লম্পট অপদার্থ সিরাজদৌল্লাকে দেশপ্রেমিক বানিয়েছি। আমরা সত্যি কথা বলতে পারি না কিন্তু আপনাদের কী ভয়?