মহম্মদ আলি করাচী থেকে দীর্ঘ পথ উড়ে নয়া দিল্লী এসেছিলেন। আনন্দভবন-নন্দনকে দাদা বলে ডেকেছিলেন। ভূস্বর্গ কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানী নরক সৃষ্টির এক ফয়সালা করার চেষ্টাও করেছিলেন। শুধু মুখের হাসি দিয়েই আবার করাচী উড়ে গিয়েছিলেন। কাজের কাজ কিছু হয়েছিল বলে মনে হয় না।
মহম্মদ আলির নিয়োগকালীন আশঙ্কার বুদবুদ শুধু মধুমাখা বিবৃতিতেই তিরোহিত হয়নি। পলাশীর আম্রকুঞ্জে যেমন একদিন ইংরেজ বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডরূপে দেখা দিয়েছিল, মহম্মদ আলির প্রধানমন্ত্রীত্বকালেও তেমনি করাচীতে মাকিনী আধিপত্যের বীজ বপন ও তাকে পল্লবিত করার দুর্নিবার প্রচেষ্টায় সিয়াটো প্যাক্টে পাকিস্তান দস্তখত করেছিল। অনাগত ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকরা গান অ্যাণ্ড গোল্ডের দেশ আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের মৈত্রীকে কি ভাবে গ্রহণ করবেন, তা সবার অজ্ঞাত হলেও, মহম্মদ আলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবেন না। এরই রাজত্বকালে পাকিস্তানের উর্বরা ভূমিতে সিভিলিয়ান পলিটিসিয়ানদের জন্ম হয়। খাকি পোশাক, মেজর জেনারেল উপাধি, মোটা শোলার হাট আর ডিফেন্স সেক্রেটারি পদ ত্যাগ করে মিঃ ইস্কান্দার মীর্জা পলিটিসিয়ানের তিলক পরে দেশ সেবার নামাবলী জড়িয়ে পূর্ব বাংলাকে সায়েস্তা করবার জন্য লাট সাহেব হয়েছিলেন। স্বাস্থের অজুহাতে অতীতের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মতন গোলাম মহম্মদকে কায়েদী আজম পদে আসান দিতে হয়েছিল। মহম্মদ আলি ও বেশী দিন সুখে কাল কাটাতে পারেননি। মীর্জার ক্রমবর্ধমান প্রাধান্য ও মুসলিম লীগের অন্তকলহ ঈশান কোণের মেঘের মতন মহম্মদ আলির সারা অন্তর নিত্য আশঙ্কিত করে তুলেছিল। পাকিস্তানী রাজনীতি সম্পর্কে আরো আশঙ্কাগুলির মতন এ আশঙ্কাও সহজে চলে যায়নি। মীর্জা গভর্নর-জেনারেল হলেন। মার্কিনী রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মধুর বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে সিয়াটো প্যাক্টের প্রিমিয়াম দিলেন। মহম্মদ আলি বাপকো বেটা সিপাহীকে ঘোড়ার মতন প্রথম বেগমকে তালাক দিলেন। এক বিদেশিনীকে গাউন ছাড়িয়ে শাড়ি পরিয়ে হৃদয় সঁপে দিলেন। জীবন যৌবন নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন মহম্মদ আলি। জীবনের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঘর বাড়িরও নতুন চেহারা সৃষ্টিতে মন দিলেন। সারা বাড়ি লাইমজুস কলারে ডিস্টেম্পার করা হল। ভিতরের লনে সুইমিং পুল তৈরি আরম্ভ হল। রাজমিস্ত্রীদের কাজ শেষ হতে না হতেই রাজত্বের পরিবর্তন ঘটলো। পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রিত্বের ধ্বজা আর একবার নড়ে উঠল। উড়ে এসে জুড়ে বসলেন সিভিলিয়ান চৌধুরী মহম্মদ আলি।
মহম্মদ আলি আবার পাক রাষ্ট্রদূত হয়ে ডালেস-তীর্থে ফিরে গেলেন।
পাকিস্তানের পরবর্তী কর্ণধার জেনারেল আয়ুব খান। পাকিস্তানের ভাগ্যবিধাতা রূপে তাঁর আবির্ভাব আকস্মিক হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। মহম্মদ আলি প্রধানমন্ত্রী হবার কিছুকাল পরেই (১৯৫৪) গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ তাঁকে নির্দেশ দিলেন, মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, সোরাবদীকে আইন মন্ত্রী ও জেনারেল আয়ুব খানকে দেশরক্ষা মন্ত্রী নিয়োগ করো। মহম্মদ আলি নিঃশব্দে সে হুকুম তামিল করলেন। তারপর একদিন ( মার্চ ১৯৫৬) গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদকে হটিয়ে ইস্কান্দার মীর্জা তাঁর গদী দখল করলেন। দেড় বছরের মাথায় মীর্জাকে সরিয়ে স্বয়ং জেনালের আয়ুব খান নিজেই পাকিস্তানের ভাগ্যবিধাতা হলেন। আয়ুব খান দীর্ঘদিন পাকিস্তানের কর্ণধার ছিলেন এবং বার কয়েক এর দর্শন পেয়েছি। তবে সব চাইতে উল্লেখযোগ্য মোলাকাত হয় ১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি লণ্ডনে।
সোভিয়েট ইউনিয়নের সরকারী আমন্ত্রণে ভারত সরকার মনোনীত ভারতীয় সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমি সে বছর সমগ্র সোভিয়েট ইউনিয়ন সফর করি। ঐ সফর শেষ করে প্রাগ ও জুরিখ ঘুরে আমি চলে যাই লণ্ডন মনাথ প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্স কভার করতে। প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এই সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন ও হারল্ড উইলসন তখন ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন আয়ুব খান এবং ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট বোধকরি রাজনৈতিক কারণেই আয়ুব খান ও শাস্ত্রীজিকে ক্লারিজস হোটেলে রাখেন।
ঐতিহাসিক মার্লবোরা হাউসে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর স্বাগত ভাষণ দিয়ে এবং তার পর পরই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রেস রিসেপশন। এটাই ব্রিটিশ ট্রাভিশন। এই রিসেপশনে সাংবাদিকরা কমনওয়েলথ দেশগুলির প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি এবং তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সঙ্গে পরিচিত ও আলাপ পরিচয় করার সুযোগ পান।
মার্লবোরা হাউসের প্রাইভেট লনের প্রবেশ পথেই হরল্ড উইলসন নিজে প্রত্যেক সাংবাদিককে এক একটি ড্রিঙ্কস তুলে দিলেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে ড্রিঙ্ক নিয়ে লনে প্রবেশ করার পর শাস্ত্রীজি আমাকে কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার মধ্যে একজন আয়ুব খান। ইস্কান্দার মীর্জার মত অহংকার বা মহম্মদ আলির মত চটুলতা লক্ষ্য করলাম না ওঁর মধ্যে। কথাবার্তা বলে মনেই হলো না উনি একজন সমরবিশারদ, বরং বিচক্ষণ রাজনীতিবি বলেই মনে হলো। অত্যন্ত ধীর স্থির ভাবেই কথাবার্তা বললেন। মাঝে মাঝে একটু হাসেন। কিন্তু সব মিলিয়ে উনি সহজ সরল ও শান্তিকামী বলে নিজেকে প্রমাণ করতে চান, ঠিক তা মনে হলো না। প্রতিদিন সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় ক্লারিজ যাই শাস্ত্রীজির কাছে। ওঁর ব্যক্তিগত সচিব জগন্নাথ সহায় ও ভেঙ্কটরমনের কাছে নানা ব্যাপারে খোঁজখবর করি। মাঝে মাঝে হঠাৎ দেখা হয় আয়ুব খানের সঙ্গে। উনি ঠাট্টা করে বলেন, আমি প্রাইম মিনিস্টার শাস্ত্রীর সঙ্গে লড়াই করছি কিনা, তাই দেখতে এসেছেন?